অর্থনীতির প্রধান সূচকে স্বস্তি, উচ্চ প্রবৃদ্ধি সচল আছে

করোনার কারণে দেশে দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে জিডিপি হয়ে গেছে সংকুচিত। কিন্তু এই সংকটকালীন সময়ে রফতানি ও রাজস্ব আয়ের সম্প্রসারণ, তেজি পুঁজিবাজার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফেরায় ২০২১ সালে বাংলাদেশ জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে।

একইসঙ্গে কৃষিখাতের প্রাণচাঞ্চল্য এবং করোনাকালীন সময়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় কোভিড পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করা গেছে।

আর শেষ হতে যাওয়া এই বছরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর ছিল স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) অনুমোদন। এর মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির স্বীকৃতি মিলল। এখন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে আসবে বাংলাদেশ।

গত এক বছরে দেশের অর্থনীতির সার্বিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর ছিল স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) অনুমোদন পাওয়া। এর মাধ্যমে গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির স্বীকৃতি মিলেছে। এখন সারা পৃথিবী বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনতে শুরু করেছে।

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, করোনার পুরো সময়জুড়ে কৃষিখাত সচল থাকায় কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা অনেক সহজ হয়েছে। তবে সরকারের ঋণ প্রণোদনার সুবিধা যেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা আরো বেশি পায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান মনে করেন করোনাকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে। ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে আমাদের অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল বলা চলে।

তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির বিচারে সদ্য সমাপ্ত বছরটি খুবই আশা জাগানিয়া ছিল। এর আগের বছরও যখন সারাবিশ্বের অর্থনীতি সাড়ে তিন শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছিল তখনো আমাদের অর্থনীতি পাঁচ শতাংশের আশেপাশেই বেড়েছিল। সেই সাফল্যের ওপর ভর করে গেল বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের বেশি হতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস। যদিও পুরো তথ্য আমাদের হাতে নেই তবুও একথা বলা চলে যে কৃষি, প্রবাসী আয়, রফতানি, আমদানিসহ সব ক্ষেত্রেই আমরা ভালো করেছি।

উল্লেখ্য, সবশেষ বিদায়ী অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। তবে বিশ্ব ব্যাংক ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে।

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কৃষি বরাবরই ভালো করেছে। বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ ও সবজির সরবরাহ খানিকটা ব্যহত হলেও বছর শেষে কৃষির উৎপাদন বেশ সন্তোষজনক বলা চলে। চালের মজুত যথেষ্ট। তবে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকায় চাল ও নিত্যপণ্যের দাম খানিকটা বেশি। ডলারের দাম বেশি বলে আমদানি করা নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে একেবারে লাগামহীন নয়। সরবরাহ চেইনের অপর্যাপ্ততার কারণে সারাবিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বাড়ন্ত। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরো বলেন, করোনার মধ্যেও বাংলাদেশে জীবিকার সুযোগ বাড়ছে। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার গতিও বাড়ছে। যদি করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রন ঢেউ অতি প্রবল না হয় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ধারা অটুটই থাকবে। আর সে কারণে টিকা দেওয়ার গতি ধরে রাখতে হবে। বুস্টার ডোজও সচল রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

আতিউর রহমান উল্লেখ করেন, গেল বছর পাঁচ লাখেরও বেশি শ্রমিক বিদেশে গেছেন কাজের সুযোগ পেয়ে। বছর শেষে মালয়েশিয়ার বাজার খোলার সংবাদ মিলেছে। বৃটেনে প্রচুর কেয়ার-গিভার নেবে জানিয়েছে। তাই সামনের বছর প্রবাসী আয়ে আরো গতি আসবে বলে মনে হয়। রফতানি খুব ভালো করছে। নতুন অর্ডার এসেছে প্রচুর। সারাবিশ্বেই ব্যবসা বাণিজ্য যেন বন্ধ না হয়ে যায় সেদিকে জনমত প্রবল। তাই আমাদের রফতানি পণ্যের চাহিদা ইতিবাচক থাকবে বলে আশা করা যায়।

তিনি জানান, চলতি অর্থ-বছরের প্রথম পাঁচ মাসে গত অর্থ-বছরের একই সময় থেকে আমদানি মূল্য বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। মূলধনী পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সূতোর আমদানি বেড়েছে শত ভাগেরও বেশি।

তিনি বলেন, তার মানে শিল্পখাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে আগামী বছর প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান দুইই বাড়বে।

ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষণে তিনি বলেন, দুই বছর পর গত নভেম্বরে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। ডিসেম্বরে নিশ্চয় এ হার আরো বেড়েছে। তা থেকেই অনুমান করা যায় যে বছর শেষে ব্যবসা- বাণিজ্য অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির যে সময়োপযোগী সমন্বয় ঘটেছে তার সুফল আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে। করোনা সত্ত্বেও অর্থনীতি তাই চাঙ্গা হতে পেরেছে।

করোনার নানামুখী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২২ সালে স্বস্তির মধ্যেই থাকবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

করোনা অতিমারির সময়ে প্রবাসীদের আয় বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন নতুন রেকর্ড হয়। আগস্টে তা ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর রফতানি আয়ে স্বস্তির খবর ছিল পুরো বছর জুড়ে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশের উপরে। এছাড়া চলতি বছরের শেষ দিকে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন স্পটসমূহে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ফলে পর্যটন খাত দুই বছরের ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

এদিকে, পুঁজিবাজারের গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেষ করেছে একটি বছর। দীর্ঘ এক দশক পর ২০২১ সাল পুরোটা জুড়েই দেশের পুঁজিবাজার ছিল গতিশীল। বাজার মূলধন ও লেনদেনে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেশের শেয়ারবাজার। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় প্রধান শেয়ারবাজারের লেনদেন বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। একইভাবে লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সার্বিক সূচক।

বেড়েছে শেয়ারদর, মূল্য সূচক, বাজার মূলধন এবং লেনদেন। বিদায়ী বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ১৩ কোম্পানি এবং তিন বন্ড তালিকাভুক্ত হয়ে ৮ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার বাজার মূলধন বাড়িয়েছে। বাড়তি এ মূলধনসহ এ বছর ডিএসইর বাজার মূলধন ৯৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা বেড়ে ৫ লাখ ৪২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

এ বছর ডিএসইর মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) বেড়ে ১৭ দশমিক ৫৮-এ উন্নীত হয়েছে। গত বছর শেষে পিই রেশিও ছিল ১৬ দশমিক ৫১। জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন বেড়ে ১৮ দশমিক ০১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মোট ১৪টি কোম্পানি আইপিও প্রক্রিয়ায় ২৯৮ কোটি টাকার প্রিমিয়ামসহ মোট ১ হাজার ২৩৩ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করেছে। এ সময়ে পুঁজিবাজারে বড় উদ্যোগ ছিল স্বল্প মূলধনি কোম্পানির জন্য আলাদা এসএমই প্ল্যাটফর্ম বা এসএমই বোর্ড চালু করা।