খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর দেশে মানুষ ছিল সাড়ে ৭ কোটি। তখন খাদ্য ঘাটতিতে ছিল বাংলাদেশ। ৫০ বছর পর দেশের মানুষ এখন ১৭ কোটির ওপরে। অথচ এখন খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই, বরং স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বাংলাদেশ আজ খাদ্যপণ্য রফতানিকারক দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে ধানের উৎপাদন ছিল ১ কোটি টনের মতো, এখন তা প্রায় ৫ কোটি টন। এই ৫০ বছরে দেশের প্রধান খাদ্যশস্যটির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। বিশ্বজুড়ে প্রতি হেক্টরে শস্যের গড় উৎপাদন হার যেখানে প্রায় ৩ টন, সেখানে বাংলাদেশে সেটি সোয়া ৪ টন। ৫০ বছরে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণেরও বেশি। গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। স্বাধীনতার বছরে দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। এসব জমিতে গড়ে ফসল ফলত একটি। ফলে খাদ্য চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশি অনুদান ও খাদ্য সহায়তার ওপর দেশকে নির্ভর করতে হতো। ৫০ বছর পর আবাদযোগ্য ৬০ শতাংশ জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও আগের চেয়ে সোয়া দুই গুণ জনসংখ্যার চাপ নিয়েও নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে পুরো খাদ্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে বাংলাদেশ। এভাবেই খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়।

দেশ স্বাধীনের পর পশ্চিমা বিশ্বের দুই ব্যক্তির দুটি মন্তব্য আজও কানে বাজে দেশের মানুষের। তার একটি হলো তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তি, ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি।’ আরেকটি হলো অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসনের মন্তব্য, ‘যদি বাংলাদেশ কখনও উন্নয়ন করতে পারে, তবে পৃথিবীর কোনো দেশই উন্নয়নে বাদ থাকবে না।’ দুজনই বাংলাদেশকে নিয়ে বাঁকা মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু ৫০ বছর পর বাংলাদেশ তাদের ওইসব বাঁকা মন্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন যেমন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, তেমনি গরিব দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। সে সঙ্গে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ।

জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টায় বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এখন মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। খুব বেশি সময় নয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে এই বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রায় শূন্য হাতে শুরু করা বাংলাদেশের খাদ্যশস্য (ধান ও গম) উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন। গত পাঁচ দশকে কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমলেও শস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। বাংলাদেশে এখন বছরে প্রায় ৫ কোটি টনের কাছাকাছি ধান উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য মতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। এ ছাড়া আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। পোল্ট্রি ও ডিম ১৭ কোটি মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। ১ হাজার ৭০০ কোটি পিস এখন বাংলাদেশের বার্ষিক ডিম উৎপাদন। কলা চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। এ সময় উদ্ভব ঘটেছে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, বাউকুল, আপেলকুল, আরবি খেজুর ইত্যাদি ফলের। আয়াতনে বিশ্বের খুব ছোট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের এ সাফল্যকে খুব বড় ধরনের অর্জন হিসেবে দেখছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।

ভুট্টা উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪৬ লাখ মে. টন। নিবিড় চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। বছরে এখন আলু উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারায় অষ্টম। আম উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ মেট্রিক টন। মাংসের উৎপাদন এখন প্রায় ৭৬ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে মাছের উৎপাদন ৪৪ দশমিক ৮৮ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন এখন ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন।

কেবল ধান উৎপাদন নয়; শাকসবজি থেকে ফলমূল কিংবা মাছ চাষ। কৃষির এমন প্রায় সবখাতেই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। কৃষিশুমারি ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিবার এখনও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে শিল্পের আধিপত্য বাড়লেও এখনও মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় যখন নতুন করে বিপর্যস্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা খাত, তখন কৃষি হতে পারে আগামী দিনের বড় নির্ভরতা- এমন মত অর্থনীতি বিশ্লেষকদের। এক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। বিবিএসের করা শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশের মোট শ্রম শক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ এখনও কৃষিতেই নিয়োজিত। কৃষির এই বিপ্লবের স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে। সংস্থাটির বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১১ দেশের কাতারে বাংলাদেশকে গণ্য করা হয়েছে। এই ১১টি দেশের মধ্যে রয়েছে- চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রাজিল- যা আয়াতনে বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বড়।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত কৃষিতে পাওয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যকে পুঁজি করেই বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। এক সময়ের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশ এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে নিরাপদ স্তরে আপৎকালীন মজুদ রেখেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য। আর কৃষি অর্থনীতিবিদরা দাবি করছেন, কৃষিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার, কৃষি বিজ্ঞানীদের উচ্চ ফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন বাংলাদেশের এই অর্জনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে।