চাঙা অর্থনীতি, রাজস্ব আদায়ে জোয়ার

করোনার প্রভাবে সৃষ্ট গভীর খাদ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে দেশের রাজস্ব খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায় বেড়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি যে চাঙা হচ্ছে, এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আদায়ে। এটি দেশের জন্য সুসংবাদ বলে মনে করেন তারা।

রোববার প্রকাশিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা রাজস্ব আহরণে সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এ সময়ে মোট রাজস্ব আহরণ হয় ৫৮ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৪৯ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের আদায়ের এই চিত্র সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে রেকর্ড তৈরি করেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২১ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে রাজস্ব আয়ে গতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে গতি আরও বেড়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি-রপ্তানিতে গতি এসেছে। চাঙা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে।

দেশে করোনা সংক্রমণ হওয়ার পর সবকিছু বন্ধ থাকায় গত বছরের এপ্রিল-মে রাজস্ব আদায় হয়নি বললেই চলে। জুন মাসেও তেমন রাজস্ব আদায় হয়নি।

গত বছরের জুলাই মাস থেকে রাজস্ব আদায় স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আর চলতি অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে করোনার আগের সময়ের ধারায় ফিরে আসে এনবিআর।

করোনার প্রথম ধাপে ২০১৯-২০ অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক বা নেতিবাচক ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী আর কখনোই এমনটি দেখা যায়নি। সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজস্ব খাত ক্রমাগত উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমদানি খাত। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এ খাতে সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ হারে আদায় বেড়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, করোনা পরিস্থিতি উন্নতির ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙা হওয়ায় আমদানির চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে আমদানি শুল্ক বাড়ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজোরে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেও আমদানি শুল্ক বাড়ে। কারণ, তখন বেশি দামের ওপর ভিত্তি করে পণ্যের শুল্কায়ন করা হয়।

এনবিআরের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আহরণ হয় ১৯ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। গত অর্থবছর একই সময়ে এটি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ভ্যাট আদায় হয়েছে ২১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে একই সময় আদায় হয় ১৮ হাজার ১১২ কোটি টাকা।

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার পর গত আগস্ট মাসে বিধিনিষেধ তুলে দেয়া হয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয়। যে কারণে ভ্যাট আহরণ বেড়েছে।

অভ্যন্তরীণ আয়ের অন্যতম উৎস আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর খাত অন্য দুটি অপেক্ষা কিছুটা পিছিয়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আয়কর আদায় বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ হারে, যেখানে গত অর্থবছরে একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয় ২ শতাংশের কিছু বেশি।

এ সময়ে আয়কর আদায় হয়েছে ১৭ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এ সময়ে আদায় ছিল ১৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এনবিআর বলছে, অর্থবছরে শুরুতে উন্নয়ন কাজের গতি মন্থর থাকায় আয়কর আদায় কম হয়। শুষ্ক মৌসুমে এডিপির কাজের গতি বাড়ে। ফলে আয়কর আদায়ও বাড়বে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এনবিআরের তিনটি উৎস– আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর আদায়ে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল সিঙ্গেল ডিজিট।

তবে আদায় পরিস্থিতি ভালো হলেও তিন মাসে রাজস্ব আদায় পিছিয়ে আছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়। ঘাটতি ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

বাজেটের মোট অর্থের ৮৬ শতাংশ জোগান দেয় এনবিআর।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ ধরা হয় মোট ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে এই লক্ষ্যমাত্রাকে অতি উচ্চাভিলাষী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

গত অর্থবছরে ২ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ধারায় ফিরছে। রেমিট্যান্স কিছুটা কমলেও রপ্তানি বাড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরছে। এসব কারণে রাজস্ব আদায় বাড়ছে।’