উন্নয়নের মাইলফলক পদ্মা সেতু

বিগত ১০ ডিসেম্বর যে দিন পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যান বসানো সম্পন্ন হলো, তার দুদিন পর আমরা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত এক বিলম্বিত প্রাতরাশের আড্ডায় যোগ দিতে স্টার কাবাবে মিলিত হয়েছিলাম। এসব আড্ডায় সাধারণত যা হয়; রাজা-উজির মারা, তার সবই হলো। এক জ্যেষ্ঠ প্রাজ্ঞ বন্ধু হঠাৎ পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গটি উঠালেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী পদ্মা সেতুর আর্থিক কোনো বাস্তব উপযোগিতা নেই; এই মেগা প্রকল্প সম্পন্ন হলে তা লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লা ভারী করবে। তার ভাষ্য অনুযায়ী একদিকে এর বর্ধিত নির্মাণ ব্যয়, আবর্তক রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা খরচ, দেখভাল করার জন্য স্থায়ীভাবে নিয়োগযোগ্য লোকবলের জন্য আবৃত্ত বাজেট, বাস্তুহারাদের আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও তাদের পুনর্বাসন ব্যয়, আর অন্যদিকে এর সুবিধা অর্থাৎ খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের ৩/৪ হাজার বাস ও ট্রাক, কিছু পণ্য ও মানুষ সড়ক আর রেলপথে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা বিবেচনায় নিলে ব্যয়ের পাল্লাই বেশি ভারী হবে। মোটের ওপর তিনি এই প্রকল্পকে ‘শ্বেতহস্তী’ এবং মিত্রপক্ষের গুলির সঙ্গে তুলনা করেন।

শ্যাম দেশে এখনো দুই একটা শ্বেতহস্তী পাওয়া যায়; কিন্তু তার ভরণপোষণের খরচ সীমাহীন। কথিত আছে, সে দেশে এক কালে রাজা যে সভাসদকে দেখতে পারতেন না, তাকে একটি শ্বেতহস্তী উপহার দিতেন, যাতে তার সংসারে দ্রুত শনির দশা শুরু হয়ে যায়। আবার অনেকগুলো পক্ষ একযোগে মিলিত হয়ে সাধারণ কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে অনেক সময় মিত্রদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের শত্রু মনে করে আত্মঘাতী গোলাগুলিও শুরু হয়ে যায়। এতে মিত্রপক্ষের অনেক সৈন্য নিহত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাজার হাজার সৈন্য মিত্রপক্ষের গুলিতে নিহত হয়। প্রযুক্তির এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও এই সেদিনকার ইরাক-আফগান যুদ্ধেও বেশ কিছু সেনা মিত্রপক্ষের গুলিতে নিহত হয়। উপমা দুইটির জাত্যার্থ ভিন্ন হলেও তাৎপর্য অভিন্ন। বর্ষা মৌসুমে ২৩০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে ১৯৬২ সালে যে কাপ্তাই লেক নির্মাণ করা হলো, তাতে ৪০ হাজারের বেশি শুধু আদিবাসী বাস্তুহারা হয়ে পড়ে; জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ওপর এর বিরূপ প্রভাবের কথা নাই বা বললাম। এখনো এই প্রকল্পের ক্ষরণ শেষ হয়নি; চলমান আছে। এটা শ্বেতহস্তী বা মিত্রপক্ষের গুলির একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।

বিদগ্ধ বন্ধুবরের কথায় আইফেল টাওয়ার নির্মাণ কালের কিছু কাহিনী মনে পড়ল। ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে পারিসে ১৮৮৯ সালে যে বিশ্ব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, তার কেন্দ্রস্থলে এই টাওয়ারটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। গুস্তাভ আইফেলের নেতৃত্বে সম্পূর্ণ ইস্পাতের কাঠামোতে তৈরি এটি যখন ওপরে উঠতে থাকে, তখন বিখ্যাত-প্রখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিক, স্থপতি, সুরকার এটাকে ‘স্থাপত্যের বেইজ্জতি’, ‘পারিসের সর্বনাশ’, ‘বেহুদা ও বিকট’ আখ্যা দিয়ে এর কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন। প্রখ্যাত লেখক আলেকজান্ডার দুমা ও গাঁই দ্যা মোপ্যাঁশা, প্রথিতযশা স্থপতি চার্লস গাঁর্নিয়ার এবং খ্যাতিমান সুরকার চার্লস গউনড ছিলেন সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম। এদের মধ্যে মোপ্যাঁশা প্রায়ই এই টাওয়ারের রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য যেতেন। পছন্দ না করা সত্ত্বেও সেখানকার সরাইখানায় নিয়মিত কেন আনাগোনাএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘,It is the only place in paris, where I did not have to see it.’ অথচ সেই আইফেল টাওয়ার আজ প্যারিসের প্রতীক। শুধু টিকিট বিক্রি করে বছরে তার ৬৮ মিলিয়ন ইউরো আয় হয়।

আমাদের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প কি আসলেই কোনো শ্বেতহস্তী বা মিত্রপক্ষের গুলি? এটা ঠিক যে, ২০০৭ সালে প্রথম যখন একনেক-এ এই প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়, তখন এর ব্যয়-প্রাক্কলন ছিল ১০১.৬২ বিলিয়ন টাকা। কয়েক দফায় ব্যয় তিন গুণ বেড়ে এখন ঠেকেছে ৩০১.৯৩ বিলিয়নে। সময় ডিসেম্বর ২০২০ থেকে বেড়ে মার্চ ২০২২ করা হলে এই ব্যয় হয়তো আরও বাড়বে। যদিও এই ব্যয় বৃদ্ধির একাধিক কারণ ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে; আরও ছিল অনিশ্চয়তা। এখন পদ্মা সেতু একটি দৃশ্যমান বাস্তবতা, একটি স্বপ্নের সুশোভিত রূপায়ণ। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতুর তাৎপর্য শুধু আর্থ-সামাজিক প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটা বাঙালি জাতির আত্ম-মর্যাদা ও আত্ম-প্রত্যয়েরও প্রতীক, হিমালয় পদানত করার চেয়েও অধিক গৌরবের।

এই সেতু নির্মাণের অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংক আমাদের কতই না নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। তাদের পীড়াপীড়িতে মিথ্যা অভিযোগে একজন মন্ত্রীর চাকরিচ্যুতি ঘটেছে; একজন সচিবকে জেলের ভাত খেতে হয়েছে। তারপরও তাদের প্রতিশ্রুত ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ-সহায়তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এক সঙ্গে চাকরির সুবাদে মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া নামের ঐ সচিবকে আমি অনেক আগে থেকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। তার মতো সৎ, দক্ষ ও নীতিবান কর্মকর্তা আমি কমই দেখেছি। অথচ তিনি হয়ে পড়েছিলেন বলির পাঁঠা। নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর অবশ্য স্বল্পভাষী, ছোটখাটো ঋজু চেহারার এই মানুষটা সরকারি চাকরিতে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিলেন; শেষমেশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানেও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সেদিন একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সানেমের (, It is the only place in paris, where I did not have to see it) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ও চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকারের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখলাম যে, এই প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ ২.৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২.১ বিলিয়নই আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবিষ্ট হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে এই জাতীয় বিনিয়োগের গুণক প্রভাবের ((multiplier effect) উৎপাদক ১.৫, যার অর্থ ১ ডলার খরচের বিপরীতে অর্থনীতিতে ১.৫ ডলারের সুবিধা তৈরি হয়। এই হিসাব থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের গুণক প্রভাবে আমাদের অর্থনীতিতে কী রকম জাগরণ সৃষ্টি হবে। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবহন ও যোগাযোগে দূরত্ব এবং সময় কমানো ছাড়াও এই প্রকল্প জাতীয় পর্যায়ে ০.৮৪ শতাংশ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে ১.০১ শতাংশ দারিদ্র্য বিমোচন করবে। তারা একাধিক মডেলিং করে প্রকল্পটি যে বেশ ভালোভাবেই টেকসই, তা অংকের হিসাব দিয়ে তুলে ধরেছেন; অর্থনীতির সে সব কচরমচর শব্দে আমি আর এই নিবন্ধকে বেসুরো করতে চাই না।

প্রকল্পের দলিল অনুযায়ী সড়ক ও রেলপথ সংবলিত ৬.১৫ কিমি দৈর্ঘ্যরে এই সেতুটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে ১.২ শতাংশ বাড়াতে সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষের কাছে এই সব অঙ্কের তেমন কোনো মূল্য নেই; তাদের কাছে বড় হলো তাদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস। এখন আর পদ্মাপাড়ের মানুষকে কার্যব্যপদেশে বা উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগী নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ফেরি পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই সেতুর পশ্চাৎভূমি ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ২১টি জেলার ৪০ মিলিয়ন মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর যে অনুকূল প্রভাব পড়বে, সেটা; সেখানে নতুন নতুন কর্মসৃজন হবে, অনেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, মানুষের আয় বাড়বে। অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা ও পশ্চাৎপদতার কারণে এই পুরো অঞ্চলটা চরম দারিদ্র্যের শিকার। এই সেতু তাদের প্রতিনিয়ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের উন্নত জীবনমানের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে সাহায্য করবে, করবে তাদের জীবন-দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা; তাদের করবে নানাভাবে উদ্দীপ্ত ও উৎসাহিত। তবে এই প্রক্রিয়াকে বেগবান করতে সরকারকেও নানা আর্থ-সামাজিক এবং পরিপূরক অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তবেই এই প্রকল্পের পুরো সুবিধা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

আরেকটি পরোক্ষ সুবিধা হতে পারে রাজধানী ঢাকায় ক্রমবর্ধমান জনচাপ হ্রাসে পদ্মা সেতুর ভূমিকা। সড়ক ও রেলপথে দ্রুত ঢাকা থেকে আসা-যাওয়ার সুবিধা তৈরি হলে অনেকেই তখন ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে না থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করতে আগ্রহী হবেন। আবার অনেক সুযোগ-সুবিধা সহজেই গ্রামাঞ্চলে গিয়ে হাজির হবে; গ্রাম আর শহরের মাঝে ব্যবধান হ্রাসের প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াও হয়ে পড়বে সহজসাধ্য। প্রকৃতিকে পোষ মানিয়ে ও বশে এনে, আবার অনেক সময় তার গতিপথ রুদ্ধ করে যে সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, পরবর্তী সময়ে সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটার এমন কিছু পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ করা যায়, যেগুলো আগে থেকে ঠাহর করা যায় না। এগুলো ইতিবাচক বা নেতিবাচকউভয় রকমই হতে পারে। তবে যমুনা সেতু প্রকল্পের অভিজ্ঞতা এই প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাকে নাকচ করে ইতিবাচক সম্ভাবনাকেই সামনে আনে।

১৯৮২ সালে রাশিয়ানরা আফগান-উজবেকিস্তান বন্ধুত্ব সেতু নির্মাণ করেছিল প্রধানত সে দেশে সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু এখন স্থলবন্দি আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে এই সেতুকেন্দ্রিক রেল-সড়কপথ তার জীবন-প্রদীপের মতো; দেশের প্রায় ৭০ ভাগ আমদানি এই সেতুর ওপর দিয়ে আসে। দুই দেশের মধ্যে কিছু উত্তেজনা থাকলেও যোহর কজওয়ে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মধ্যে উভয়ের পারস্পরিক সুবিধা সৃজনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরকে কাঁচামাল, সস্তা শ্রমশক্তি ও পর্যাপ্ত ভূমি সরবরাহ করে, আর সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার এই অংশে পর্যাপ্ত পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকে। উভয় দেশের পর্যটকদের প্রায় ৫০ শতাংশ এই সেতুপথে যাতায়াত করে। ১৮৮৩ সালে নির্মিত ব্রুকলিন ব্রিজ লং আইল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের একটি দূরবর্তী পশ্চাৎপদ জলমগ্ন ভূখণ্ডকে নিউ ইয়র্কের একটি সমৃদ্ধিশালী শহরে রূপান্তর করে। এই ব্রিজ নির্মাণের পর মাত্র ১৫ বছরে ব্রুকলিনের জনসংখ্যা ৫,৮০,০০০ থেকে ১০ লাখে উন্নীত হয়। লোকজন ম্যানহাটানে কাজ করে সে অর্থ ব্রুকলিনে বাড়িঘর তৈরি করত, ছোটখাটো ব্যবসা গড়ে তুলত, আর গণপরিবহনে যাতায়াত করত। এই ব্রিজ দিয়ে এখনো প্রতিদিন ১,৪০,০০০ যানবাহন চলাচল করে। এটি এখন নিউ ইয়র্ক স্টেটের পাঁচটি শহরের মধ্যে সর্বাধিক জনঘনত্বের শহর।

আমাদের বিশ্বাস পদ্মা সেতু অনগ্রসর দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলকে উন্নত ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে একীভূত করার ক্ষেত্রে ব্রুকলিন ব্রিজের ভূমিকা পালন করবে। সে সুযোগ তৈরি করতে সরকার দ্রুত পরিপূরক এবং সম্পূরক অবকাঠামোগত ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করবে, যাতে এই মেগা প্রকল্পের সুবিধা সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে যায়। আসলে সাধারণ মানুষের উন্নতিই দেশের উন্নতি।

বদরুল হাসান
খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক