ডেস্ক রিপোর্ট: কক্সবাজার জেলার ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী। দ্বীপের পৌর শহরের গোরক ঘাটার বড় রাখাইন পাড়া ও লামার পাড়ার ৮০০ পরিবারের বাপ দাদার আদি পেশা শৈল্পিক কাপড় বোনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন ৫ হাজার লোক।
কাঁচামাল সংকট, পুঁজির অভাব, হাতে বোনা কাপড়ের ন্যায্য বাজার মূল্য না পাওয়াসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে রাখাইন সম্প্রদায়ের হাতে বোনা তাঁত শিল্প বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
বড় রাখাইন পাড়া ও লামার পাড়ার রাখাইন পল্লী ঘুরে মাত্র ২টি পরিবারে শৈল্পিক কাপড় বোনার দৃশ্য দেখা যায়। কাপড়ের ব্যাগ, চাদর, শাড়ি, লুঙ্গি, বেড সিড, তোয়েলা ও গামছা তৈরিতে তারা খুবই পারদর্শী। তাদের তৈরি কাপড় পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তাই কক্সবাজারে আগত পর্যটকদের একটি বড় অংশ আদিনাথ মন্দির ও মহেশখালীর রাখাইন পল্লীগ্রামে বেশি সময় কাটান। বিশেষ করে রাখাইন তরুণ তরুণীদের অতিথি আপ্যায়ন মুগ্ধ করে পর্যটকদের।
যদিওবা রাখাইনরা নিজেদের হাতে বোনা শৈল্পিক কাপড় খুবই সীমিত পরিসরে চলছে, তার পরও রাখাইন পল্লীগ্রামের শত শত নারী পুরুষ সুদূর রাঙ্গামাটি থেকে বিচিত্র বা রকমারী হাতে বোনা কাপড় এনে পসরা সাজিয়ে বসেছে রাখাইন পল্লী মার্কেটে। আকর্ষণীয় এই মার্কেটে শুধু হাতে বোনা কাপড়েই বিক্রি হয়।
রাখাইন মার্কেটের ঊর্মিমালা নামের রাখাইন যুবতী এ প্রতিবেদককে জানান, মাত্র বছর দুয়েক আগে ও নিজেরা প্রতিটি ঘরে ঘরে কাপড় বুনে বিক্রি করতাম। কিন্তু কালক্রমে স্থানীয় শিল্পীরা নানান দৈন্যদশার কারণে কাপড় বুনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারপরও বাপ দাদার পেশার ঐতিহ্য ধরে রাখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে রাঙ্গামাটি থেকে হলে ও হাতে বুনা কাপড় এনে দোকানে বিক্রি করছি। আমার মতো সকল রাখাইন আজ তাই করছে। অনেকে এ পেশা থেকে সরে গিয়ে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি, বিপণন ও জেলে পেশায় চলে গেছে। বিশেষ করে পুরুষদের অধিকাংশতো বটেই। আর নারীরা বেশীর ভাগই বেকার। তাই চরম দৈন্য দশার মধ্যেই অধিকাংশ রাখাইনদের সংসার।
আদু মং নামের এক রাখাইন ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন দোকান খুলছি আর বন্ধ করছি বেচাবিক্রি খুবই কম। পর্যটন মৌসুমে মোটামুটি বেচা বিক্রি ভাল হয়।আর বর্তমান করোনাকালীন সময়ে খুব খারাপ সময় অতিবাহিত করছি আমরা।
এদিকে লামার পাড়া রাখাইন পল্লীতে মাত্র দু’টি বাড়িতে খুব সীমিত পরিসরে কাপড় বুনতে দেখা গেছে। মংপু ও মালি মং নামের এই দম্পতির বাড়িতে কাপড় বুনার দৃশ্য দেখা যায়।
তারা বলেন, আমরাও বিকল্প পেলে এই পেশা ছেড়ে দেব। কারণ এ পেশায় পরিশ্রম আর পূ্ঁজি বিনিয়োগ করে আমরা পোশাতে পারছিনা। সরকারি পৃষ্ট পোষকতা ছাড়া এ শিল্প কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে-না। ঐতিহ্যবাহী মহেশখালীর রাখাইন তাঁত শিল্পের চরম ক্রান্তি কাল চলছে।
এই দম্পতি আরো বলেন, আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প রাখাইনদের হাতে বুনা তাঁত শিল্প বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে উপনীত। শত বছরের এই শিল্প বিলুপ্তি ঘটলে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অধ্যায়ের পরি সমাপ্তি হবে বলে মনে করেন রাখাইন এই দম্পতি। আরেক পরিবার দেখা গেল মা, মেয়ে মিলে চালাচ্ছেন হাতে বুনা তাঁত।
মধ্য বয়সী রাখাইন নারী পিংপং মং বলেন, তার স্বামী মারা গেছে চার বছর আগে। চার মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে তার। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। দুই মেয়ে নিম্ন মাধ্যমিকে পড়া লেখা করে। ছেলেটির বয়স ৬ বছর। সে সবার ছোট। মেজ মেয়ের নাম টিং টিং মং সে চট্রগ্রাম সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এসএসসিতে সে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। এখন কলেজ বন্ধ করোনার কারণে, তাই মায়ের সঙ্গেই হাতে বুনা কাপড় তৈরি করছে ঘরে বসেই। পরিবারে এক মাত্র টিং টিং মং এর মা-ই মূলতঃ উপার্জন করেন শুধু মাত্র কাপড় বুনে।
রাখাইন সম্প্রদায়ের অন্যতম অভিভাবক মহেশখালী পৌরসভার কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মং লায়েন বলেন, মহেশখালীর আদিবাসী পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর রাখাইন সম্প্রদায় অবহেলিত। এই সম্প্রদায়ের আদি পেশা ছিল হাতে বুনা কাপড় তৈরি করে তা বাজারজাত করা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই বাঁচার তাগিদে অনেকে পেশারও পরিবর্তন করেছে। ফলে মুছে যেতে বসেছে হাতে বুনা কাপড়ের ইতিহাস ঐতিহ্য। তারপরও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রাখাইন আদিবাসীদের এই পুরনো পেশায় ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘ মিয়াদী সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে বহুমুখী পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে সহযোগিতা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। শীঘ্রই এর সুফল পাবে আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়।
অন্যদিকে এই অঞ্চলের স্থানীয় এমপি আশেক উল্লাহ রফিক জানান, রাখাইন আদিবাসীদের হাতে বুনা সূতি কাপড় তৈরি বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটন আকর্ষণ হারাবে ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী। তাই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প রাখাইন পল্লীগ্রামের কাপড় বুনা ও বিপণন ধরে রাখতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।