
২০১৯ সালের বৈশ্বিক লিঙ্গ বিভাজন সূচক (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫০তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বেও নারীর এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, বাল্যবিয়ে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের প্রাধান্য না দেওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে নারীর ক্ষমতায়ন নিঃসন্দেহে বেড়েছে বলে মনে করেন নীতিনির্ধারকরা। যদি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় তাহলে আরো এগিয়ে যাবে নারী। একই সঙ্গে নারীর ইচ্ছাশক্তি অটুট থাকলে এই গতি ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার প্রশাসনের উচ্চপদে নারীর ক্ষমতায়ন ও পদায়ন করেছে। বাংলাদেশের নারীরা আজ এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে তারা পুরুষের সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।’
গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বে অগ্রাধিকার
সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অগ্রাধিকার নারীর ক্ষমতায়নকে আরো এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে এক হাজার ৭৯৫ জন নারী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ১২৩। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত নারী কর্মকর্তার হার ২২.৩ শতাংশ। দ্বিতীয় শ্রেণির নারী কর্মকর্তার হার এর প্রায় দ্বিগুণ, ৪৩.৪ শতাংশ। ২০১৭ সালে বিভাগীয় ও ডেপুটি কমিশনার (প্রথম শ্রেণির) নারী কর্মকর্তার হার ২৭ শতাংশ।
সংসদ ও তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়ন
দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। সংসদে নারী আসন ৪৫টি থেকে বাড়িয়ে ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো নারী স্পিকার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়নে উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য তিনটি সংরক্ষিত আসন সৃষ্টি করা হয়।
বিবিএসের তথ্য মতে, ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদে নারী চেয়ারম্যানের হার ছিল ০.৬ শতাংশ। ২০১৭ সালে এই হার বেড়ে ১.২ শতাংশে দাঁড়ায়। ওই বছর ৩১ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন নারী। ২০১৪-২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদে নারী ভাইস চেয়ারম্যানের সংখ্যা ৪৮৬ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ১০২ জন নারী ভাইস চেয়ারম্যান আছেন।
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হেলেনা আক্তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়ন হলে নারীর কর্মসংস্থান, সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে আমরা কাজ করতে পারি। সমস্যা ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি। আমাদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করলে আরো বেশি কাজ করতে পারব।’
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি
উন্নয়নমূলক এবং প্রাতিষ্ঠানিক যৌথ পদক্ষেপের মাধ্যমে বৈষম্যমূলক বাধাগুলো দূরীকরণ ও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিতকরণ ছিল সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৬-২০) লক্ষ্য। এ ছাড়া সংবিধানের আলোকে নারী-পুরুষ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে সুসংহত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত হয়, যার লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও আইনগত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। এরপর ২২টি লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি পুনর্গঠন ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
নারীর ক্ষমতায়নে কর্মসংস্থান
২০৪১ সাল নাগাদ নারীর কর্মসংস্থান ৫০:৫০-এ উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে সরকার। নারী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও নির্যাতন প্রতিরোধে ৫১ লাখ নারীকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ, উপজেলা পর্যায়ে আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ (আইজিএ) প্রকল্পের মাধ্যমে তিন লাখ ৮১ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ, জয়িতা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২৮ হাজার নারী উদ্যোক্তার সক্ষমতা বৃদ্ধি, তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে এক কোটি নারীর ক্ষমতায়ন, ৬৪ জেলায় ৪২ হাজার নারীকে কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ, তৃণমূলে দুই লাখ ৫৬ হাজার নারীর প্রশিক্ষণের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত ৫০ বছরে নারীর অবস্থায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন পেশায় নারীরা তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। নারীরা যত নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাবে, সমাজে তাদের তত গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।’