পাসপোর্টের দুষ্টচক্র ভাঙতে সফটওয়্যার

জরুরি নতুন পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেছেন আপনি। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও জমা দিয়েছেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পেতে। ভেরিফিকেশনের জন্য যে পুলিশ সদস্য আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তার পেছনেও ‘সামান্য খরচাপাতি’ করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হলেও হাতে পাচ্ছেন না পাসপোর্ট। এমনকি কী কারণে পাসপোর্ট আটকে আছে, তাও জানতে পারছেন না। অনেক সময় পাসপোর্টপ্রত্যাশীরা এমন দুর্ভোগের মুখোমুখি হন।

পাসপোর্ট ঘিরে এমন হয়রানি, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে একটি সফটওয়্যার কাজ করছে। এই সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসপোর্টপ্রত্যাশীর কাছে সব ধরনের তথ্য পৌঁছে দেবে। পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে পুলিশের কাছে কারও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য আবেদন পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি মেসেজ যাবে আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে। সেখানে লেখা থাকবে, ভেরিফিকেশনের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বর। ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে যথাযথ সেবা না পেলে অভিযোগ জানাতে পৃথক একটি নম্বর থাকছে। এরই মধ্যে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার ৯৬টি থানায় বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাসপোর্ট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স-সংক্রান্ত সেবা প্রদান শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাসপোর্ট ঘিরে দুষ্টচক্র ভাঙতে চায় পুলিশ।

এ ছাড়া রিমান্ডে নেওয়া আসামির সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে কিনা বা তার স্বজনের কাছ থেকে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা পুলিশ নিল কিনা, তা বের করতেও আরেক উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ। সেই মডেল অনুসরণ করে যাতে পুলিশের অন্য সব ইউনিট একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর চিঠি দিয়েছে।

রেঞ্জ অফিস থেকে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স তদারক করছেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে আবেদন ফরম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সফটওয়্যারে এন্ট্রি দিতে হয়। এন্ট্রি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেদনকারীর মোবাইলে একটি এসএমএস যায়। একইভাবে তদন্তকারীর মোবাইল নম্বরে যায় আরেকটি মেসেজ। আবেদনকারীকে কোনো হয়রানি করা হলে তিনি রেঞ্জ অফিসের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে অভিযোগ জানাতে পারেন। রেঞ্জ অফিস থেকেও আবেদনকারীকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়- তার কাছ থেকে কোনো অর্থ চাওয়া হয়েছে কিনা। এ ছাড়া অন্য কোনোভাবে কেউ ভেরিফিকেশন বাধাগ্রস্ত করছে কিনা।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা ভেরিফিকেশন সম্পন্ন না করলে সফটওয়্যারে এন্ট্রি স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাল হয়ে যায়। এরপর ওই তদন্ত কর্মকর্তাকে জবাবদিহির মধ্যে আনা হয়। কেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা যায়নি, সে ব্যাপারে তার কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়ে থাকে।

তদন্ত শেষ হওয়ার পর সংশ্নিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা আবেদন ফরমটি পাসপোর্ট অফিসে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে সফটওয়্যারে এন্ট্রি দিতে হয়। এন্ট্রি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শেষ ও আবেদন ফরম পাসপোর্ট অফিসে পাঠানো হয়েছে- এই তথ্য জানিয়ে আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে আরেকটি এসএমএস চলে যায়। পাসপোর্টের মতো পুলিশ ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়াও একইভাবে করা হয়ে থাকে।

জানা গেছে, ডিবির হাতে গ্রেপ্তার বা অভিযান-সংক্রান্ত তথ্য প্রতিদিন ছক আকারে তৈরি করছে ঢাকা রেঞ্জের ৯৬টি থানা। সেখানে অভিযানের কারণ, গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে আনা আসামি ও তার স্বজনের মোবাইল নম্বর থাকে। এরপর রেঞ্জ অফিস থেকে গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে থাকা আসামির স্বজনের কাছে ফোন করা হয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো অর্থ দাবি করা হয়েছে কিনা। গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে থাকা আসামির সঙ্গে কোনো নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে কিনা। রেঞ্জ অফিস থেকে আসামির স্বজনের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেলে সংশ্নিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কাছে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রিমান্ডে থাকা আসামি ও তার স্বজনের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযোগ পাওয়া যায়। অধিকাংশ সময় তারা দাবি করেন, রিমান্ডে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। কোনো কোনো সময় পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কেউ মারা গেলে দেশব্যাপী তোলপাড়ও শুরু হয়। সর্বশেষ বরিশালে পুলিশ হেফাজতে রেজাউল করিম রেজা নামে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় পুলিশ। এর আগে সিলেটেও পুলিশ হেফাজতে রায়হান আহমেদ নামে একজন মারা গেলে তা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বাহিনীকে।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, পুলিশের কাছ কেউ সেবা নিতে এসে যাতে হয়রানি ও ভীতির মুখোমুখি না হন, এটা নিশ্চিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন নিয়ে অতীতের জঞ্জাল দূর করতে চাই আমরা। সব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নানাভাবে আমরা প্রত্যেকের কাজ মনিটর করছি। এরই মধ্যে এর সুফলও মিলছে।

ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, প্রতি মাসে গড়ে ঢাকা রেঞ্জের সব থানা মিলে মামলা হয় আড়াই হাজারের মতো। জিডি হয় পাঁচ-ছয় হাজার। আর পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের আবেদন আসে প্রতি মাসে ৩০ হাজারের মতো। এত সংখ্যক মানুষ পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে এসে নির্বিঘ্নে সেবা না পেলে পুলিশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়। তারা যাতে পাসপোর্ট ঘিরে কোনো পুলিশি হয়রানির মুখোমুখি না হন, তাই সফটওয়্যার আনা হয়েছে।