প্রেরণার উদ্যোগ: ওরা মাস্কও বানাচ্ছে

ওরা ১৪ জন। প্রত্যেকেই নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী। একজন বাদে সবার বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেই। জন্মের পর পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের চোখে তারা অবহেলিত ছিল। কিন্তু এখন তারা স্বাবলম্বী। করোনা মহামারিতে সবকিছুই যেখানে স্থবির হয়ে পড়ে, সেখানে পরিবারের সদস্যদের চোখে একমাত্র অক্ষম মানুষটিই সংসারের হাল ধরেন। প্রেরণা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পিএফডিএ থেকে ‘সেলাই ও কাটিং’-এর প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা নিজেরাই ঘরে বসে তৈরি করছেন স্বাস্থ্যসম্মত মাস্ক। এদের মধ্যে কেউ শিক্ষকের দেওয়া নির্ধারিত মাপ অনুযায়ী কাপড় কাটেন, আবার কেউ সেলাই করেন, কেউ আবার সুতা কাটেন। কাপড়ে হ্যান্ডপেইন্টিংও করেন। তাদের হাতে তৈরি চার স্তরবিশিষ্ট এই ফেব্রিক মাস্ক (নোজ ক্লিপযুক্ত) ব্যবহারে সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যায়। পরীক্ষিত ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সর্বোচ্চ ২০ বার ধুয়ে ব্যবহারযোগ্য। টেকসই এসব মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মনোবল জাগিয়ে রাখতে ক্রেতারা নিজেসহ প্রিয়জনদের জন্য ‘প্রেরণা মাস্ক’ ক্রয় করছেন। ফলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে প্রেরণা মাস্ক।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সেই ১৪ তরুণের মধ্যে ১০ জন হলেন- সাকিব রহমান, আব্দুল্লাহ আল নাফি অন্তর, শিহাব শাহরিয়ার, দীপঙ্কর দে তীর্থ, হিশাম ইসলাম, সিয়ামুল করিম, রুমি আক্তার, সাফওয়ানুল আমিন, ফয়সাল মাহমুদ ও সাকিব খান। শুধু শিহাব শাহরিয়ারের বয়স ৩০ এবং তিনি অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী। বিশেষভাবে সক্ষম এই তরুণদের নিজ হাতে তৈরি প্রতিটি মাস্কের পেছনে রয়েছে অসংখ্য বাধা অতিক্রম করে উঠে আসার গল্প।

সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান-১-এর সুপারস্টোর রিটেইল চেইন ‘স্বপ্ন’ আউটলেটে গিয়ে দেখা যায়, সুপারস্টোরের প্রবেশমুখেই রাখা হয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে কাপড়ের তৈরি মাস্ক। সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান ডাইসিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড দ্বারা পরীক্ষিত এই মাস্ক। দাম ৩০০ টাকা। শীতের শুরুতেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে আবার মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সাধারণ মাস্কের চেয়ে এখন মানুষ কাপড়ের তৈরি মাস্কের প্রতিই বেশি আগ্রহী। তার মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে তাদের তৈরি মাস্কের প্রতিও ক্রেতাদের আগ্রহ দেখা যায়।

করোনাভাইরাসের কারণে মাস্ক হয়ে গেছে মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রেরণা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পিএফডিএ ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার এই মহামারিকালে সমাজের বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ফেস মাস্ক বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই উদ্যোগকে স্বীকৃতি জানাতে এগিয়ে আসে সুপারশপ ‘স্বপ্ন’।

প্রেরণা ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টায় এখন অনেকেই আবার নিজ কর্মস্থলে ফিরেছেন। আর তাই সঠিক নিয়ম মেনে মাস্ক ব্যবহার করা এখন আরও বেশি প্রয়োজন। পুনর্ব্যবহারযোগ্য ফেব্রিক মাস্ক ব্যবহারের কিছু সাধারণ নিয়মাবলি রয়েছে। তা মানতে পারলে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা সম্ভব। মাস্কটি একটি পরিস্কার, বায়ুরোধক প্লাস্টিক ব্যাগের মধ্যে সংরক্ষণ করতে হবে। পুনরায় ব্যবহারের জন্য মাস্কের ফিতার অংশে ধরে ব্যাগ থেকে বের করুন। দিনে অন্তত একবার হালকা গরম পানিতে সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে মাস্কটি ধুয়ে নিতে হবে। মাস্ক পরার কিংবা খুলে ফেলার পর সাবানপানি অথবা হ্যান্ড রাব দিয়ে হাত পরিস্কার করতে হবে।

স্বপ্ন সুপারশপে কথা হয় রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে আসা ক্রেতা ইয়াসিন রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাধারণত স্বপ্ন থেকেই সব বাজার করে থাকি। মাস্কসহ অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী এখান থেকেই নেওয়া হয়। গত মাসে এসে জানতে পারি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাতে তৈরি মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে। তাই কৌতূহল থেকে এক পিস কিনি। ব্যবহারে আরাম পাওয়া যায়। তা ছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত। তাই গ্রামে পাঠানোর জন্য আরও পাঁচ পিস কিনে নিলাম।’

স্বপ্নের বিক্রয়কর্মী সুমি জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি ভালোবাসা থেকে ক্রেতারা এই মাস্কগুলো বেশি কেনেন। শুধু স্বপ্নের গুলশান-১ আউটলেট, গুলশান-২ আউটলেট, বনানী বাজার আউটলেট এবং উত্তরা-৩ নম্বর সেক্টর আউটলেটে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের তৈরি এই মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে।

গুলশান-১ আউটলেটের ম্যানেজার নিয়াজ মাহমুদ সমকালকে বলেন, প্রতি প্যাকেটে এক পিস করে মাস্ক স্বাস্থ্যসম্মত প্যাকেটিং পাওয়া যাচ্ছে। গুণগত মানের কারণে ক্রেতাদের মধ্যে দিন দিন এর চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মাস্কগুলোর বিক্রিও বাড়ছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধিতা জরিপ কর্মসূচি সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৫৮০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধীপ্রবণ এলাকা হিসেবে কুমিল্লা জেলাকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই জেলায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৬৮ হাজার ৭৯৭ জন, যা মোট সংখ্যার ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। রাজধানী ঢাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৫ হাজার ১২২। অর্থাৎ ঢাকায় ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষের কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। করোনা সংকটকালে তাদের অবস্থা খুব নাজুক ছিল। নানারকম প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তারা জীবনযুদ্ধে লড়াই করছে। তাই তাদের অধিকার, ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

অটিজম নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের সংকটময় পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান এবং ‘অ্যাঞ্জেল শেফ’-এর উদ্যোক্তা সাজিদা রহমান ড্যানি বলেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের স্বাবলম্বী করতে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যই তিনি পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার শুরু করেন। পিএফডিএর শিক্ষার্থীরা ২০১৫ সালে বেকারি ও ফুড সার্ভিসের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকেই অ্যাঞ্জেল শেফ বাজারে বেকারি পণ্য নিয়ে আসে ক্রেতাদের জন্য। এর বাইরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিচালনায় একটি ‘হট কিচেন’ ও ৯টি আউটলেট পরিচালনা করতে পেরেছে। করোনাকালে তাদের জীবনসংগ্রামে টিকিয়ে রাখতে সেলাই-কাটিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের তৈরি মাস্কই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানান, করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে চলতি বছরের মার্চ থেকে অ্যাঞ্জেল শেফের ২৭ জন কর্মীর মধ্যে ২৪ জনকে সাময়িক বসিয়ে রাখা হয়েছে। বিক্রিতে ভাটা পড়ায় তাদের বেতন দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। তখনই প্রেরণা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

প্রেরণা ফাউন্ডেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুল আমিন সমকালকে বলেন, ‘কভিড-১৯ মহামারি সমস্ত বিশ্বের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং সমাজের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও এর থেকে রেহাই পাননি। এই মানুষগুলোর জন্য নিরাপদ ও টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রেরণা ফাউন্ডেশন ও পিএফডিএ এক হয়ে একটি মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট, শ্রেণিভিত্তিক পশ্চাৎপদতা ও অসম শ্রমবাজারকে কেন্দ্র করে গৃহীত এই প্রকল্প। সুযোগের অভাবে পিছিয়ে পড়া বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের মূল কর্মধারায় সংযুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই প্রেরণা ফাউন্ডেশন ও পিএফডিএ হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।’

সমাজের চিরায়ত দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিয়ে নিপুণতার সঙ্গে এই বিশেষ মেধার অধিকারীরা প্রতিদিন তৈরি করছেন অসংখ্য প্রেরণা মাস্ক, যা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রেরণা ফাউন্ডেশনের ‘আমরা শিখি, আমরা পারি’ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় প্রবর্তিত ‘প্রেরণা মাস্ক’ প্রকল্পটি প্রমাণ করেছে, এই বিশ্ব মহামারির সময়েও যথাযথ পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও সমতা নিশ্চিত করতে পারি। প্রেরণা ফাউন্ডেশন এবং পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত ‘প্রেরণা মাস্ক’ প্রকল্পটির সফলতা আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, এ ধরনের পরিকল্পনা অনুকরণে আমরা আমাদের সবার জন্য নিশ্চিত করতে পারি এক অভিনব ভবিষ্যৎ, যেখানে সমতা শুধু স্বপ্ন নয়, বরং হয়ে উঠবে অজস্র অনুপ্রেরণার উৎস।