গভীর সমুদ্রে রয়েছে মত্স্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের অতলে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। এছাড়াও শামুক, ঝিনুক, শ্যালকিস, কাঁকড়া, অক্টোপাস ও হাঙ্গরসহ রয়েছে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থকারী সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত। সঠিকভাবে আহরণ করে এগুলো রপ্তানি করতে পারলে অর্থনীতির চাকা খুলে যাবে। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সির’ তথ্যমতে সমুদ্র থেকে শুধু মাছ ধরে বিদেশে রপ্তানি করেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। গভীর সমুদ্রের টুনা মাছ সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামি এই মাছটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা হয়ে থাকে। এই মাছ সঠিকভাবে আহরণ করতে পারলে নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। সমুদ্রের তলদেশে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা রয়েছে; এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরি করা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ইসপিরুলিনা। প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিশ্বে এ দুটি ধাতুর চাহিদা কত মূল্যবান তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া সিমেন্ট শিল্পের প্রচুর পরিমাণে ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে বঙ্গোপসাগরের ৩০-৮০ মিটার গভীরে। অগভীর সমুদ্র থেকে এসব ক্লে উত্তোলন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পেও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিভিন্ন তথ্যমতে—বিশ্বে ৪৩০ কোটির বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিন জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্র তলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেল ক্ষেত্র হতে। ঢাকা চেম্ব্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (DCCI) হিসাব মতে, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রের মাছ আহরণ, সামুদ্রিক খাদ্য ও বাণিজ্যিক সমুদ্র পরিবহন হতে। দেশের প্রায় ৩ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রনির্ভর সম্পদকে যথাযতভাবে কাজে লাগিয়ে যদি দেশীয় অর্থনীতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয় তাহলে ভিশন-২০৪১ পূর্ণ করা সহজ হবে। ফলে আমরা অতি দ্রুতই উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছে যাব।
বাংলাদেশের এত বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনাময় সমুদ্র সম্পদের যথাযতভাবে আহরণ ও ব্যবহার করতে পারছি না বলে আজ আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই, কীভাবে একটি দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে নরওয়ে। আজ ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। যা ২০২৫ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধরা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এত বিপুল পরিমাণ সমুদ্রসীমা বেষ্টিত অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও আমরা এই অপার সম্ভাবনাময় সম্পদের যথাযত ব্যবহার করতে পারছি না। বর্তমানে বাংলাদেশের ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৩৫-৪০ নটিক্যাল মাইলের বেশি মাছ আহরণ করতে পারে না অথচ আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০০ নটিক্যাল মাইল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে- প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয় কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে ৯০ হাজার টন মাছ ধরতে পারে মাত্র।
সময় এসেছে সমুদ্রনির্ভর এই বিশাল শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণের। ব্লু ইকোনমি নিয়ে গবেষণা, কার্যকর পদক্ষেপ ও উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। যদিও সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি করতে চীন প্রস্তাব দিয়েছে, জাপানও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও হাতে নেওয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে- একটি জরিপ কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা উচিত, যেখান থেকে খুব সহজেই সমুদ্র সম্পদ আহরণের তথ্য মিলবে। নতুন করে ফের ব্লু ইকোনমি নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক, সমুদ্রের তলদেশে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ ব্যবহার করতে হলে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তি দরকার; এখনো সেই পরিমাণ জনশক্তি ও প্রযুক্তি আমাদের দেশে নেই। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকে এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বিদেশি দক্ষ সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে একযোগে কাজ করা যেতে পারে। সমুদ্রনির্ভর এ অপার সম্ভাবনাময় সম্পদের যথাযথ আহরণ ও সঠিক ব্যবহারে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নতুন বিভাগ চালু করে গবেষণাগার তৈরি করা যেতে পারে। এ সময় দক্ষ জনবল গঠনে সরকারকে দ্রুত কার্যকারী পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে সমুদ্র সম্পদের কাজে লাগাতে পারলে একদিকে যেমন দেশের বৃহত্ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়ে বেকারত্ব নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে দেশ। সব মিলিয়ে আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিবে ব্লু-ইকোনমি।