সবার ঘরে বিদ্যুৎ ডিসেম্বরেই

দেশের প্রতিটি ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে। ১১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা অনেকটা স্বপ্ন মনে হলেও নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। এই বছরের ডিসেম্বর মুজিববর্ষের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুত্সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হবে। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলেই মাত্র ১১ বছরেই বিদ্যুৎ খাতে বড় বিপ্লব ঘটেছে।

বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৫ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোড শেডিং শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের আগে এই শতভাগ বিদ্যুৎ লক্ষ্য পূরণে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল। এর মধ্যে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আবার মানুষ নিজের গ্রাম, আদি নিবাস ছেড়ে ‘মাঠে-প্রান্তরে’ কিংবা নতুন সড়কের পাশে বাড়িঘর তৈরি করছে। ফলে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদার জোগান দেওয়ার পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিদ্যুৎ বিভাগকে এগোতে হচ্ছে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সাফল্যের দৃষ্টান্তও রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত্সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের রূপকল্পে ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর। কিন্তু এক বছর এগিয়ে নিয়ে অবশিষ্ট ৩ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুত্সুবিধার আওতায় এনে এ বছরের ডিসেম্বর মুজিববর্ষেই শতভাগ বিদ্যুৎ ঘোষণা করা হবে। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

পাওয়ার সেলের তথ্য মতে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুেকন্দ্রের সংখ্য ছিল ২৭টি। বর্তমানে বিদ্যুেকন্দ্রের সংখ্যা ১৩৭টি। মাত্র ১১ বছরেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১১৭টি বিদ্যুেকন্দ্র হয়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। ১১ বছর আগে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি ৭০ লাখ। সঞ্চালন লাইন যেটা ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, সেটা এখন ১২ হাজার ২৮৩ সার্কিট কিলোমিটার। গ্রিড সাবস্টেশনের ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ, সেটা বেড়ে এখন হয়েছে ৪৫ হাজার ১৯৪ এমবিএ। ২০০৯ সালে বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার কিলোমিটার। ১১ বছর আগে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১০ কিলোওয়াট ঘণ্টায়। এখন বিতরণ লস : ৯.৩৫ শতাংশ। গত ২৯ মে ২০১৯ দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন রেকর্ড হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জ্বালানি সংকটের কারণে ১১ বছর আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতির উত্তরণে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মিশ্র ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যাসের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। সরকার তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদ্যোগ নেয়। সরকারের ধারাবাহিকতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। নীতিমালা সহজ করায় বিভিন্ন বেসরকারি কম্পানিও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। তা দেশের বিদ্যুৎ খাতকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুৎ খাত ছিল চরম অস্থিতিশীল। ওই সময় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই কম থাকায় দিন-রাত লোড শেডিং লেগেই থাকত। দ্রুততম সময়ে চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্য রক্ষায় সরকার ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেয়। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ায় এ খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। এরপর সরকার মধ্যমেয়াদি এবং পরে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেয়। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে মিশ্র জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তেল-গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়।

কমেছে লোড শেডিং
বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে লোড শেডিং হওয়ার সুযোগ নেই। মূলত লোড শেডিং হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে একদিকে সংযোগ দিয়ে অন্যদিকে সংযোগ বন্ধ রাখা। উৎপাদন বেশি থাকায় সে অবস্থা আর নেই। তার পরও মাঝেমধ্যে লোড শেডিং হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বর্তমানে দুইটি বিষয়ের জন্য লোড শেডিং দেখা দেয়। একটি হলো এখন সারা দেশে বিদ্যুৎ উন্নয়নে প্রচুর কাজ হচ্ছে, উন্নয়নকাজের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করতে হয়। সে কারণে কোনো একটি লাইনে কাজ হলে সেটাকে বন্ধ রাখলে ওই এলাকায় তখন বিদ্যুৎ থাকে না। দ্বিতীয় কারণ হলো—উৎপাদন ও গ্রাহক বাড়ছে কিন্তু ট্রান্সফিউশন ডিস্ট্রিবিউশন শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। সে কারণে কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো আমরা চিহ্নিত করে কাজ করছি। আগামী এক মাস পরে এগুলোও থাকবে না।’

নবায়নযোগ্য জ্বালানি
নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় একটি প্রসার হয়েছে। বর্তমানে ৫৮ লাখ সোলার হোম সিস্টেম দিয়ে গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুত্সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। বায়ু বিদ্যুতের জন্য উইং ম্যাপিং হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৬২৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ বছরের মধ্যেই মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নেবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হলো গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, যার ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের সরকার বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা প্রদান করছে।