বিদেশ থেকে পুরনো বা স্ক্র্যাপ জাহাজ এনে ভাঙা হয় দেশের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে। সেই জাহাজ ভাঙা পণ্য দিয়ে দেশের কারখানায় তৈরি হয় লোহা। এই জাহাজ ভাঙায় আবারও বিশ্বে শীর্ষে ওঠে এল বাংলাদেশ। আগে জাহাজ ভাঙা লোহার পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ এক নম্বরে থাকলেও এবার জাহাজ সংখ্যা ও পণ্যের পরিমাণ দুই দিক থেকেই শীর্ষে ওঠে নতুন রেকর্ড গড়ল।
এ ছাড়া ২০১৯ সালে ভারত ২০০ জাহাজ ভেঙে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আর তৃতীয় স্থানে আছে তুরস্ক; যারা ভেঙেছে মাত্র ১০৭টি। মঙ্গলবার ‘এনজিও শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফরম’ প্রকাশিত রিপোর্টে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে ৬৭৪টি পুরনো জাহাজ ভাঙা হয়েছে; এর মধ্যে বাংলাদেশ এককভাবে ২৩৬টি জাহাজ ভেঙে রেকর্ড গড়েছে। বিশ্বে মোট জাহাজ ভাঙার ৩৫ শতাংশই বাংলাদেশে; যার সবগুলোই চট্টগ্রামের সাগর উপকূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভাঙা হয়েছে। বাংলাদেশ ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টনের ২৩৬টি জাহাজ ভেঙেছে। আর ভারত ভেঙেছে ২শটি জাহাজ; যাতে ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার টন লোহা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ৩৬টি জাহাজ বেশি ভেঙেছে আর জাহাজ ভেঙে দ্বিগুণের বেশি লোহা পেয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সাগর উপকূলজুড়ে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে সব জাহাজ ভাঙা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাহাজ ভেঙেছে এস এন করপোরেশন; যার মালিক শওকত আলী চৌধুরী।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা বলছেন, বর্তমানে ৬০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড সচল আছে; যেখানে বছরে মোট এক কোটি টন (জিআরটি) ভাঙার সক্ষমতা রয়েছে। সেই সক্ষমতার বিপরীতে ২০১৯ সালে সাড়ে ৭৮ লাখ টন (জিআরটি) জাহাজ ভাঙা হয়েছে।
জাহাজ ভাঙা শিল্পে পরিবেশ দূষণ এবং মৃত্যুর হার কমানো নিয়েও প্রতিবাদ করে আসছে পরিবেশবাদী এনজিওগুলো। এ থেকে উত্তরণে ইয়ার্ড মালিকরাও বসে নেই। ইতোমধ্যে নিরাপদ এবং পরিবেশসম্মত সব শর্ত (কমপ্লায়েন্স) পূরণ করে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক গ্রিন সার্টিফিকেট পেয়েছে পিএইচপি শিপ ইয়ার্ড। ইতোমধ্যে জাপানভিত্তিক ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি ‘ক্লাস এনকে’ গত ১৫ জানুয়ারি এই ইয়ার্ডকে নিরাপদ ও পরিবেশসম্মত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে এই ইয়ার্ডে বিশ্বের ভালো জাহাজগুলো আসছে।
পিএইচপি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, ‘আমি এখন বিশ্বে স্বীকৃত ভালোমানের জাহাজ ভাঙার জন্য পাচ্ছি। ভালো মানের জাহাজ পেলে দামও ভালো পাওয়া যায়। এ জন্য আমার ইয়ার্ডকে ৬০ কোটি টাকা খরচ করে প্রস্তুত হতে হয়েছে।’
আরো অনেকে আন্তর্জাতিকমানের ইয়ার্ড করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ বছর আমাদের অনেকগুলো কমপ্লায়েন্স ইয়ার্ড প্রস্তুত হবে। ফলে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো এবং বাড়তি জাহাজ ভাঙতে পারবো। সবার কমপ্লায়েন্স পূরণে সরকারি সহযোগিতা দরকার।’
জানা গেছে, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে জাহাজ ভেঙে সেই স্ক্র্যাপ পণ্য সরবরাহ করা হয় দেশের রি-রোলিং মিলগুলোতে। আর মিলগুলো প্রথমে বিলেট তৈরি করে পরে সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের লোহা তৈরি করে বাজারজাত করে; যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইস্পাত তৈরিতে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান বলেন, ‘এটা নিশ্চিত দেশের মেগা প্রকল্পের কারণে রডের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এই চাহিদা আরও কয়েক বছর থাকবে। তবে এই চাহিদা ধরে রাখতে প্রাইভেট সেক্টরকে গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ জোগান দেয় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড বা জাহাজ ভাঙা শিল্প। কাস্টমসের শীর্ষ ২০টি রাজস্ব আয় প্রদানকারী খাতের মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্প ১১ নম্বরে আছে। কাস্টমসের হিসাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার জাহাজ ভাঙা হয়েছে; আর এই খাত থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩৪৫ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার জাহাজ ভাঙা হয়েছে আর রাজস্ব আয় হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা।