বিজয়ের পর নেতিবাচক অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বের কাছে উপহাস হয়েছিল বাংলাদেশ। তলাবিহীন ঝুড়িসহ নানা উপাধি পাওয়া দেশটি এখন ৪৮ বছর পর বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে। বিনিয়োগ থেকে শুরু করে জিডিপির প্রবৃদ্ধি- সবক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে বাংলাদেশে।
১৯৭১-৭২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল নেতিবাচক। তৎকালীন অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে হয়েছিল ১২.৬ শতাংশ। অথচ বর্তমানে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। গত ২৮ আগস্ট দ্য স্পেক্টেটর ইনডেক্সে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে সারাবিশ্বের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ শীর্ষে। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৮৮ শতাংশ। একই সময়ে বিশ্বের প্রথমসারির অন্যান্য দেশের, যেমন- চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭৭ শতাংশ, ভারতের ১১৭, ব্রাজিলের ৯৭ এবং ইন্দোনেশিয়ার ৯০ শতাংশ। অন্যদের অবস্থান আরও অনেক পেছনে।
১৯৭১-৭২ এর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর কিন্তু দেশজ উৎপাদনের অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে মাত্র এক বছর সময় লেগেছে। ১৯৭২-৭৩ এর ভিত্তিমূল্যে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৩ শতাংশ। মূলত কৃষি খাতে নবজাগরণ ও নতুন শিল্পকারখানার প্রস্তুতি নেওয়ার কারণেই এই অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৯.৪ শতাংশ।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ১.৭ শতাংশ। আর ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল মাত্র ২.৯ শতাংশ। কিন্তু সামরিক শাসন ও বিভিন্ন অস্থিরতার মধ্য দিয়েও দেশের জিডিপির যথাযথ্য উন্নয়ন হতে পারেনি। যার কারণে ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। সামরিক শাসন ও অস্থির রাজনীতির কারণে দেশের জিডিপি আশানুরূপ প্রবৃদ্ধির হার হয়নি। ১৯৮৪-৮৫ অর্থমূল্যের ভিত্তিতে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ২.২৫ শতাংশ।
এর পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৩.৪ শতাংশ। এর পর ধীরে ধীরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৫.৩ শতাংশ।
সরকার পরিবর্তন হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রথমে একটু হ্রাস পেলেও পরে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫.২৩ শতাংশ হয়, আর ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে হয়েছিল ৪.৮৭ শতাংশে। কিন্তু তার পরবর্তী ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৫.৯৪ শতাংশ। এর পর আবারও সরকার পালাবদল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে থাকে। ২০০১-০২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে হয়েছিল ৪.৪২ শতাংশ। তবে এর পর ২০০২-০৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৫.২৬ শতাংশ।
পরে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৬.২৭ শতাংশ। এর পরবর্তী সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার স্থির ছিল।
এর পর সরকারের পালাবদল সময় আবার সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ক্রমবর্ধমান জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে থাকে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৬.০১ শতাংশ, আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৫.০৫ শতাংশে।
এর পর আবার সরকার বদল হওয়ার পর রাজনৈতিক কিছুটা স্থিরতা আসে। ফলে ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৫.৫৭ শতাংশ, যা পরের দুই বছরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৬.৫২ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৬.০৬ শতাংশ। এর পর নির্বাচনপরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক স্থিরতা থাকার কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল ৬.৫৫ শতাংশ আর তা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হয় ৭.০৫ শতাংশ। বর্তমানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ধরা হয়েছে ৮.২০ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক স্থিরতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ভিত্তিমূল্য বিভিন্ন সময় ধরা হয়েছে। যদি ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর ভিত্তিমূল্য ধরা হতো, তা হলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পেত।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা প্রায় ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর সব রকম প্রস্তুতি রয়েছে।
১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৮৮ শতাংশ, সেখানে আজ এ হার কমে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০০৫ সালে ছিল ৪০ শতাংশ, আর ২০০০ সালের জরিপে ওই অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ। উন্নয়ন কর্মকাে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে আমাদের স্থিতিশীলতা সন্তোষজনক। আমরা কাগজ-কলমে ও বাস্তবেও মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছি। কিন্তু উন্নত দেশ হতে চাইলে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন ও ব্যবসা শুরুর পদ্ধতি আরও সহজীকরণ করতে হবে।