উন্নত কার্প ও দেশীয় ছোট মাছ উৎপাদনে ব্রুড ব্যাংক স্থাপন
গুণগত মানসম্পন্ন কার্প জাতীয় ও দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশে স্থাপিত হয়েছে ব্রুড ব্যাংক। সরকারি ও বেসরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ ও পোনা উৎপাদনে ব্রুড ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। ব্রুড মাছ বলতে প্রাপ্ত বয়স্ক কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন প্রজননক্ষম পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে বোঝায়। হ্যাচারিতে গুণগত পোনা উৎপাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নত মানের ব্রুড মাছ।
বাংলাদেশ যখন মৎস্য সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণ তখনও কিছু কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম (উন্নত গুণসম্পন্ন পোনা উৎপাদনে জন্য) গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছের অপর্যাপ্ততা সেই সঙ্গে দেশীয় ছোট প্রজাতির মাছের (এসআইএস) বিলুপ্তির আশঙ্কা। এসব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে মৎস্য অধিদফতর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ব্রুড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায়)’ হাতে নেয়। যার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি ও বেসরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ ও পোনা মাছ উৎপাদন এবং উন্নত কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন কার্প ও দেশীয় ছোট প্রজাতির (এসআইএস) ব্রুড স্টক তৈরির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
এ লক্ষ্যে প্রাকৃতিক উৎসের রেণু হতে (হালদা, পদ্মা, যমুনা নদী) ৩৫ টন কার্প ব্রুড তৈরি করা হয়েছে এবং এসব কার্প ব্রুড থেকে ৫০ টন রেনু উৎপাদন করা হয়েছে যেখান থেকে পরবর্তীতে ৩০ লাখ কার্পের পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও গুলসা, পাবদা, শিং ও মাগুর এর ০.২৮ টন এসআইএস ব্রুড তৈরি করে সেখান থেকে ৩.১ লাখ পোনা উৎপাদন করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় এ বছর প্রায় ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও বিগহেড কার্পের সর্বোচ্চ জেনেটিক গুণসম্পন্ন ৩৯ হাজার পোনা চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৪০ বছর পূর্বে আশির দশকে বিদেশ থেকে কিছু কিছু প্রজাতির মাছ আমদানি করা হয়েছিল মাছ চাষ উন্নয়নে ব্রুড মাছ ও পোনা মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে। যার মধ্যে এই তিনটি প্রজাতির মাছ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কম খরচ ও উৎপাদন বেশি হওয়ায় এই প্রজাতির মাছগুলো ব্যাপকভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এত বছরের ব্যবধানে এই প্রজাতিরগুলোর মধ্যে আন্তঃপ্রজনন হার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পরবর্তীতে উৎপাদিত পোনাগুলোর বৃদ্ধির হার ও গুণগতমান কমতে থাকে।
এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে এবং ভবিষ্যতের জন্য গুণগতমানের পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনটি প্রজাতির প্রায় ৩৯ হাজার পোনা আমদানি করা হয়েছে। যেগুলোকে নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্রুড মাছে পরিণত করা হচ্ছে। পোনাগুলোকে আমদানির সময় এদের আকার ছিল ৩-৫ সেন্টিমিটার। মাছগুলো ‘আমুর’ নদীর যেটা চীন ও রাশিয়ায় মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাছগুলো তিন বছর খামারে প্রতিপালন করার পর ব্রুড মাছে পরিণত হবে। পরবর্তীতে মাছগুলো দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি খামারে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ব্রুড ব্যাংক স্থাপন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের সাতটি বিভাগের ২৩টি জেলার ২৭টি সরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ব্রুড ব্যাংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. সিরাজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মৎস্য চাষ ও চাষভিত্তিক জলাশয় ব্যবস্থাপনার ফলে গুণগতমানের পোনার চাহিদা, হ্যাচারি উৎপাদিত পোনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গত দুই দশকে হ্যাচারিতে রেণু ও পোনা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বেসরকারি হ্যাচারি মালিকদের কারিগরি জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব, অধিক মুনাফার চিন্তা-চেতনা, সঠিক প্রযুক্তি অনুসরণ না করা, আন্তঃপ্রজনন ও শংকরায়ন সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার গুণগতমান বেশিরভাগই নিম্নমানের।
ফলে মাছের উৎপাদন কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়ায় মৎস্য অধিদফতর কর্তৃক ব্রুড ব্যাংক স্থাপন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উন্নত কৌলিতাত্ত্বিক গুণাগুণসম্পন্ন ব্রুড মাছ ও মৎস্য বীজ উৎপাদনের জন্য ব্রুড ব্যাংক প্রকল্পটির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন তথা সব মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণীজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে প্রকল্পটি ব্যাপক অবদান রাখবে। এ ছাড়া মাছ চাষি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষসহ প্রায় ৩০ হাজার জন বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছে এ প্রকল্প থেকে। তা ছাড়া মৎস্য চাষিরা চাইলে সরকারি মৎস্য বীজ খামার থেকে উন্নতমানের পোনা সংগ্রহ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, ব্রুড ব্যাংক সফলভাবে স্থাপনের পর দেশের প্রায় ১ মিলিয়ন লোক সুফল ভোগ করবেন।
মৎস্য অধিদফতরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব মতে, দেশে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৮৪৮ টন কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছে। এটা মোট মাছ উৎপাদনের ৩৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেলের মতো দামি কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৭ টন, যা মোট উৎপাদনের ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও ব্রিগ হেড কার্পসহ এ জাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ টন, যা মোট উৎপাদনের ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ।
বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ হাতে নিয়েছে। বর্তমান সরকারের এসব লক্ষ্য পূরণে এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে মৎস্য সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় এবং চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে।
ব্রুড ব্যাংকের মাধ্যমে মাছ চাষ করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান মন্ডল বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টর অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ দেশের মৎস্য চাষকে সমৃদ্ধ ও টেকসই করার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন পোনার দরকার। আর এর জন্যই প্রয়োজন গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ। বাংলাদেশ সরকারের ব্রুড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্পটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রকল্পটির সম্প্রসারণ ও সার্বিক উন্নয়ন এ দেশের মৎস্য উৎপাদনকে আরও ত্বরান্বিত করবে।