সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কমেছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু

নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও গত এক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি হয়েছে অভূতপূর্ব। বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এ অগ্রগতি এখন দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে, দেশ অর্জন করছে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মাননা। একসময় দেশে বড় সমস্যা ছিল শিশু ও মাতৃ মৃত্যু বাড়তে থাকার প্রবণতা। এখন তা দ্রুত নামছে নিচের দিকে। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র। অবকাঠামোর পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে দক্ষ প্রসবকর্মী। দেওয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী।

সরকারের এসব উদ্যোগের সঙ্গে কাজ করছে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা। ফলে এখন প্রসবকেন্দ্রে প্রসবের হার বেড়েছে, দুর্গম অনেক এলাকায়ই চালু করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টা প্রসূতিসেবা কেন্দ্র। এ ছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যের বিষয়ে আরো জোর দেওয়া হয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য স্কিম, মাতৃত্বকালীন ভাতা, মাতৃমৃত্যু, মৃত জন্ম ও নবজাতকের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা কার্যক্রমের মতো উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে সারা দেশের সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের অনেকগুলোতেই এখন নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির জাপাইগো প্রকল্পের বাংলাদেশের উপদেস্টা ডা. জেবুন নেছা রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, মা ও শিশু মৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে সরকারের অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ খুবই ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ; দক্ষ প্রসবকর্মী তৈরি, মাঠপর্যায়ে অবকাঠামো নির্মাণ, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া, কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম জোরালো করা, বাজেটে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এককথায় নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে এই সরকারের খুবই আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিশু তহবিল, জাতিসংঘ জনসংখ্যা বিভাগ ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ট্রেন্ডস ইন মেটার্নাল মর্টালিটি : ১৯৯০ থেকে ২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল (প্রতি এক লাখে) ৫৬৯ জন। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৭৬ জনে। অর্থাৎ বছরে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৪.৭ শতাংশ হারে। সেই হিসাবে এই ২৫ বছরে মাতৃমৃত্যু কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ, যা ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ওই প্রতিবেদন অনুসারে একই সময়ের ব্যবধানে ভারতে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৬৮ দশমিক ৭ এবং পাকিস্তানে ৫৮ দশমিক ৭ হারে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ২০২২ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ১০৫-এ নামিয়ে আনার টার্গেট রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক কর্মসূচির মধ্যে। এ ছাড়া জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে ৭০-এ নামিয়ে আনার টার্গেট তো আছেই।

ইউনিসেফের আরেক প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে বিশ্বের যেসব দেশ মাতৃমৃত্যু হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

যদিও বাংলাদেশ মেটার্নাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে (বিএমএমএইচএস) অনুসারে বাংলাদেশে ২০০১ সালে মাতৃমৃত্যু হার ছিল প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৩২২, ২০১০ সালে তা নেমে আসে ১৯৪-তে। ২০১৬ সালে আরেকবার ওই সার্ভেতে ওই হার ১৯৬-তে উঠে যাওয়ার একটি প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ করা হলেও তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকারি পর্যায় থেকে ওই হার আগের তুলনায় আরো কমেছে বলে দাবি করা হয়।

সেই সঙ্গে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যু হারও আরো কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জোরালোভাবে কাজ চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারেই ২০০৭ সালে শিশুমৃত্যু হার ছিল প্রতি হাজারে ৬৫, যা এখন নেমে এসেছে ৩৪-এ। ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্যে শিশু মৃত্যু হার দেখানো হচ্ছে ৩৪ দশমিক ২। অবশ্য একই সূত্রের তথ্যে ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে শিশুমৃত্যু হার ৭৩ শতাংশ কমেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।