সবুজ পাট গাছে সোনালী স্বপ্ন

 

কুমিল্লা শহর ছাড়িয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চারিপাড়া, ষাটশালা, রানীগাছ ও নুনহাটি গ্রাম। পাশাপাশি লাগোয়া গ্রামগুলির সবুজ-শ্যামল বিস্তীর্ণ মাঠ ঘুরে দেখা যায়, বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছে লিকলিকে শরীরে বাড়তে থাকা সবুজ পাটগাছ। কোমর ছাড়িয়ে বুক সমান উচ্চতায় বেড়ে উঠা এসব পাট ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিক। সতেজতা ছড়ানো সবুজের আবির-রাঙ্গা এ পরিবেশ যেনো চোখের সামনে তুলে ধরে শ্যামল বাঙলার প্রাকৃতিক মুগ্ধতা।

উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের এ ক’টি গ্রাম ছাড়াও কান্দুঘর, রাজাবাড়ী, বারানী গ্রামের চিত্রও একই রকম। এছাড়াও গোমতী নদী সংলগ্ন মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া, রামনগর, আছাদনগর, চন্ডিপুর, মনোহরপুর এলাকাতেও চোখে পড়ে সবুজের দ্যুতি ছড়ানো এ দৃশ্য।

অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে বাড়তে থাকা সবুজ পাটগাছ সোনালী স্বপ্ন দেখাচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকদের। আর স্বপ্ন-বিভোর কৃষকেরা আশা করছেন বাম্পার ফলন ও ন্যায্য দামের।

 

জানা গেছে, এ বছর অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি পাটের চাষ বেশি করেছেন ব্রাহ্মণপাড়ার কৃষকরা। উপজেলার প্রায় সব গ্রামেই কম-বেশি পাটের আবাদ হয়েছে। আর গত কয়েকদিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এ বছর সঠিক সময়ে পরিমাণ মতো বৃষ্টি এবং অনুকূল আবহওয়ায় পাটের ফলনও অন্য কয়েক বছর থেকে অনেক ভালো হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে এই উপজেলায় ২১০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর আবাদ কিছুটা কম হলেও ফলন তুলনামূলক ভালো হয়েছে বলে মনে করছেন উপজেলা কৃষি অফিসের কর্তারা। আর কৃষকরা বলছেন, ফলনের পাশাপাশি দামও যদি ভালো পাওয়া যায়, তবে আগামীতে আরো বাড়বে পরিবেশ বান্ধব এ আঁশ-ফসলের আবাদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লার ১৬টি উপজেলার মধ্যে পাটের চাষ বেশি হয় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায়। এছাড়াও জেলার বুড়িচং, দেবীদ্বার, মুরাদনগর, মনোহরগঞ্জ, লাকসাম, বরুড়া ও চান্দিনা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কৃষক পাটচাষ করে থাকেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর পূর্বে হঠাৎ করেই পাটের দাম কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকেরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তেমনি লোকসানের মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরাও।

 

লাভের আশায় বাজার থেকে পাট কিনে মজুদ করে পরবর্তীতে তা বিক্রি করতে হয়েছে লোকসানে। ফলে বাধ্য হয়েই পাট ব্যবসা ছেড়ে অন্যদিকে মনোনিবেশ করতে হয় তাদের। একই অবস্থা হয়েছে কৃষকদেরও। লাভের মুখ না দেখে পাট চাষ ছেড়ে দিয়ে ধান চাষে বেশি ঝুঁকেন তারা। এতে করে একটা সময় এসে কুমিল্লা অঞ্চলে অস্বাভাবিকভাবে কমে যায় পাটচাষ। সঙ্কটে পড়ে এক সময়ের সোনালী আঁশের অস্তিত্ব।

কিন্তু বর্তমান সরকার খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যে পরিবেশ বান্ধব পাটের মোড়ক বহুবিদ ব্যবহার করায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাটের উৎপাদন ও বাজার দর। ফলে গেলো কয়েক বছর যাবৎ প্রান্তিক পর্যায়ে চাষিদেরও পাট চাষে আগ্রহ বাড়ছে। সোনালী আঁশ ঘিরে সোনালী স্বপ্ন ভাসছে খেটে খাওয়া অজপাড়া গাঁ’র কৃষকদের চোখে মুখে।

বিষয়টির সাথে একমত পোষণ করে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মতিউল আলম বলেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় পাট কম পরিশ্রমে অধিক লাভজনক একটি ফসল। কম খরচে ভাল ফলন হওয়ায় বর্তমান সময়ে এসে কৃষকরা আবারো পাটচাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গেলো কয়েকবছর যাবৎ পাটচাষের পরিমাণও বাড়ছে।

এ বছর কৃষকরা আউশ ধান আবাদে বেশি ঝুঁকেছে উল্লেখ করে মতিউল আলম বলেন, অতিরিক্ত আউশ ধান আবাদের ফলে ব্রাহ্মণপাড়ায় এ বছর পাটের আবাদ কিছুটা কমেছে। তবে কৃষকরা যদি পাটের আগাম জাত ও উচ্চ ফলনশীল বীজ রোপণ করে তাহলে তারা অনেকটাই লাভবান হবেন। উচ্চ ফলনশীল ও আগম জাতের পাটের বীজ রোপণ করলে তা স্বল্প সময়ে মাঠ থেকে উঠে আসে এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার প্রকৃতিক সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা থাকে না।

এছাড়া সরকারি ভাবে কৃষকদের নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

পাটের সুদিনের অপেক্ষায় থাকা মনোহরপুর গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আবদুল বারিক জানান, একটা সময় পাটই ছিলো আমাদের ‘ভরসার’ ফসল। বাপ-চাচারা কতো কষ্ট করে আমাদেরকে সাথে নিয়ে পাট চাষ করতেন। পানিতে ডুবে ডুবে ‘জাগ’ দিতেন, ভালোভাবে পঁচলে তারপর মাচা পেতে আঁশ ছড়াতেন…। কিন্তু হঠাৎ করেই যেনো সব কিছু ‘নাই’ হয়ে গেলো!’

ইদানিং আবারো পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধিতে আপ্লুত এ মানুষটি বলেন, ‘কতো মায়া লাগে, চিকন গাছে কচি কচি পাতা। পাট গাছ তো আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই মিশে আছে!’

 

পাটের লাভজনক দিকটি সামনে এনে চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক আবদুল জলিল বলেন, ‘গত বছর ফলন ভালো হওয়ায় এবং চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকেরা এবারও পাট চাষের প্রতি ঝুঁকেছে।’ তার মতে, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সঠিক সময়ে জমিতে বীজ বপন করার সুযোগ পাওয়ায় পাটের বাম্পার ফলন হবে। বাজারে ভালো দাম পেলেই স্বার্থক হবে পরিশ্রম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেলো কয়েক বছর ধরে জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় পাটচাষের পরিমাণ ক্রমাগত হারে বাড়ছে। ২০১৫ সালে এই উপজেলায় দেশি জাতের পাটের চাষ হয়েছিল ১৫০ হেক্টর এবং তুষা জাতের পাটের চাষ হয়েছিল ২০ হেক্টর। ২০১৬ সালে এসে এর পরিমাণটা দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশি। সে বছর ব্রাহ্মণপাড়ার কৃষকরা দেশি জাতের পাট চাষ করেন ৩৮০ হেক্টর জমিতে। আর তুষা জাতের পাটের চাষের পরিমাণ ছিলো মাত্র ২ হেক্টর জমি। ২০১৭ সালে পাট চাষকৃত জমির পরিমাণ ছিলো প্রায় ৩শ’ হেক্টর। এছাড়াও গেলো বছর কৃষকরা কেবল দেশি জাতের পাটই চাষ করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় এ বছরও অনুপস্থিত তুষা জাতের পাট চাষ।

জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সোনালি আঁশের কাঙ্খিত দাম নিয়ে তাদের মাঝে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও কাটার পর পচানোর জায়গা নিয়ে তেমন চিন্তা নেই। বৈশাখের শুরু থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের ধারা বর্ষা পর্যন্ত অব্যাহত থাকায় খাল-বিলে থৈ থৈ করছে পানি। এখন অপেক্ষা কেবল পাট গাছ থেকে সোনালী আঁশ ছাড়িয়ে তা বাজারে এনে বিক্রি করা। আর সেখানে ন্যায্য দাম মিললেই কৃষকদের মুখে লেগে থাকা হাসিটা আরও রঙ্গিন হবে; সীমানা ছাড়িয়ে যাবে সবুজ পাটগাছের সোনালী আঁশ ঘিরে তাদের স্বপ্নের বিস্তৃতি…।