যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।- রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন পাকিস্তানের বঞ্চিত ভূখণ্ড থেকে আজকের অগ্রগতির বাংলাদেশের কথা বলছে। নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার ছিল পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গত ৪৬ বছরে আর্থসামাজিক উন্নয়নের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের রোল মডেল। অন্যদিকে পাকিস্তানের পরিচিতি দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় পিছিয়ে পড়া এক রাষ্ট্র হিসেবে।
পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এ ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। এ অঞ্চলের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সে অবস্থার পরিবর্তন করেছে অনেক আগেই। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। একই অর্থবছরে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত এক দশক ধরে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি থাকার পর সর্বশেষ দুটি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এ হার ৫ শতাংশ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন যেতে না যেতেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেন তৎকালীন শাসকেরা। এ অঞ্চলের ব্যবসা থেকে অর্জিত সম্পদ পাচার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ হতো। পূর্ব পাকিস্তানের নামে নেওয়া ঋণ ব্যবহূত হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের নানা তথ্য রয়েছে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় :একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৫০-৫৫ সালে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের ৭০ কোটি টাকা জোটে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে। পশ্চিম পাকিস্তান পায় ২০০ কোটি টাকা। ১৯৫৯ থেকে ‘৭০ সাল পর্যন্ত সরকারি রাজস্ব থেকে ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ পায় পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়। অবহেলিত থেকে যায় এ অঞ্চল। সেই ‘বৈষম্যের ভূখণ্ড’ এখন বিশ্ববাসীর চোখে ‘উন্নয়নের বিস্ময়’।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়েছে। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর। বাংলাদেশের চেয়ে ২ বছর বেশি ছিল তাদের গড় আয়ু। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর, যা পাকিস্তানের চেয়ে ৬ বছর বেশি। জাতিসংঘের সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ১৮৮ দেশের মধ্যে ১৩৯তম। পাকিস্তান পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে ৮ ধাপ। ৫ বছরের কম শিশু মৃত্যুহারেও এক সময় বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের পর প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানে এ সংখ্যা ৭৯ জন। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার এক সময় অনেক বেশি ছিল। এক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এ হার ৭২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, পাকিস্তানের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশকে এখন তুলনা করতে হবে স্থিতিশীল কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে। কেননা পাকিস্তানে দীর্ঘমেয়াদে কখনও সুশাসন ছিল না। সে দেশে মৌলবাদী আন্দোলন অনেক শক্তিশালী। তারপরেও বিজয়ের মাসে পাকিস্তানের তুলনায় আমরা কতটা এগিয়ে সে আলোচনা এসে যায়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার আগে সব সূচকে আমরা পিছিয়ে ছিলাম। এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। এর অন্যতম কারণ, ১৯৯০ সালের পর থেকে মোটামুটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে অনেক সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ওর স্যালাইনের মতো অনেক উদ্ভাবন রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের মতো উদ্ভাবনের সফল প্রয়োগ হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো দেশের উন্নয়নে অনেক সক্রিয়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই সামাজিক রূপান্তর ঘটেনি। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে শিল্পেও রূপান্তর ঘটেছে। কৃষির বহুমুখীকরণ হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। ওদের জমি অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে তারা রূপান্তর ঘটাতে পারেনি।
ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। বায়ুদূষণ বেড়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। বাংলাদেশকে এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে।
গত সেপ্টেম্বরে দি ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদেন বলা হয়, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন পাকিস্তানের তুলনায় এ দেশ অনেক দরিদ্র ছিল। জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ আসত শিল্প খাত থেকে। ৪৬ বছরের মাথায় বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ১৫৩৮ ডলার, পাকিস্তানে যা ১৪৭০ ডলার।
স্বাধীনতার পর মানুষের মুখে দুটো অন্ন তুলে দেওয়াই ছিল এ দেশের জন্য অনেক কঠিন কাজ। সেই দেশ এখন গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮। পাকিস্তানের অবস্থা এ সূচকে ১০৬। বাংলাদেশ ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের মতো এত দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেনি কোনো দেশ। ২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। পাকিস্তানে এ হার ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ।