চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের মেয়ে শারমিন আক্তার, বয়স ২৬ বছর। পরিবারের বড় সন্তান তিনি। বাবা-মা ও পাঁচ ভাইবোনসহ তাদের অভাবের সংসার। বাবা মনির হোসেন শেখ একজন দরিদ্র কৃষক। সাতজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। এমন অবস্থায় এইচএসসি পরীক্ষার পর অভাবের কারণে বন্ধ হয়ে যায় শারমিনের লেখাপড়া। ফলে পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায় শারমিন। পরিবারে কোন আর্থিক সহায়তাও করতে পারছিল না সে। দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয় তার। এছাড়া মাথার উপর ছিল বিয়ের খড়গ। কি করবে বুঝতে পারছিল না শারমিন। কিন্তু এই অন্ধকার থেকে তাকে আলোর পথে নিয়ে আসে অ্যাপ্রেনটিছশিপ প্রোগ্রাম। শারমিন জানতে পারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘একসেস টু ইনফরমেশন’ (এটুআই) প্রোগ্রামের উদ্যোগে চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়াতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেলাই বিষয়ক অ্যাপ্রেনটিছশিপ প্রোগ্রাম শুরু হচ্ছে। হাতে-কলমে এ প্রশিক্ষণ শেষে সার্টিফিকেট দেয়া হবে এবং মিলবে কাজ করার সুযোগ। শারমিন প্রশিক্ষণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ভর্তি হন। ছয় মাসব্যাপী সালোয়ার-কামিজসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরিবিষয়ক হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণকালীন ভাতা দিয়ে দুটি সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির পাশেই টেইলার্সের কাজ শুরু করে তিনি। শুরু হয় শারমিনের সাফল্যের পথচলা। মাসে প্রায় আট হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। এই টাকা দিয়ে ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ চলছে। দুঃখ ঘুঁচে হাঁসি ফুটেছে তার পরিবারে। এখন শারমিন স্বপ্ন দেখছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার। শারমিনের মতো অসংখ্য নারী অ্যাপ্রেনটিছশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে বিছিন্ন থাকলেও এখন সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার কারণে বিমান বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদেরকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সরকারের ইসতেহার অনুযায়ী জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়া, দক্ষ মানব উন্নয়ন, সমাজের সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা এবং একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) একটি জেন্ডারকৌশল তৈরি করেছে। এ কৌশলের উদ্দেশ্য হলো সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে সুবিধাবঞ্চিত নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে সমানভাবে নিশ্চিত করা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পটি নারীর দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও এ কার্যালয়ের মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধি, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থাপিত ৮টি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ৩.৫৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে যার ৬৪ শতাংশ নারী। দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ২০১১-১২ হতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ৩৬৪টি আয়বর্ধকমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর মোট উপকারভোগী প্রায় ৮০ হাজার যার মধ্যে ৫০ শতাংশ নারী। ৫০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন, ছিন্নমূল ও দরিদ্র পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২০ হাজার পরিবারকে ঋণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ১৪ হাজার ৮৪ জন নারীকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
নারী উন্নয়ন ও সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এর অধীন সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং বিআরটিসি বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় চলমান প্রকল্পসহ সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ার নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। বিআরটিসি’র মহিলা বাস সার্ভিস চালু কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের যোগাযোগের বাধাসমূহ দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মহিলাদের স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের সুবিধার্থে মহিলা বাস সার্ভিস সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে মহিলা বাস সার্ভিসে ১৮টি বাস ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। বিআরটিসি ১৭টি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ওয়েল্ডিং, পেইন্টিং ও ড্রাইভিং বিষয়ে ২০০৯ হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৯৮০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে এর মধ্যে মহিলা প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৭ জন। বিআরটিসি বাসে মহিলা গাড়িচালক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মহিলা কন্ডাক্টর নিয়োগ করা হয়েছে।
নারী উন্নয়ন, অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে বর্তমানে ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৫টি, রাজশাহী জেলায় ২টি, চট্টগ্রাম জেলায় ৩টি ও বগুড়া জেলায় ২টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। অর্থাৎ ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৬টি জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ নারী উন্নয়নে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে এবং নারীদের অধিকতর সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলা শহরে স্থাপিত ৭টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে গত তিন বছরে ২ হাজার ৫৬১ জন নারীকে প্রত্যক্ষ সেবা প্রদান করা হয়েছে। ১ হাজার ৯৮৮ জন নারীকে আইনি ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে এবং ৯১৮ জন নারীকে পুনর্বাসনে সহায়তা দেয়া হয়েছে। এ বিভাগটি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর নারী সদস্যদের আয়বর্ধক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৮ হাজার ২৭১ জন নারী সদস্যকে বিভিন্ন মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। এছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘অ্যান্টি ট্রাফিকিং মেকানিজম অ্যান্ড মনিটরিং’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে পাচার ভিকটিম, বিশেষত নারী ও শিশু ভিকটিম ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের উদ্ধার কার্যক্রম থেকে পুনর্বাসন পর্যন্ত সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
এভাবে বর্তমান সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতর সংস্থাসমূহ নারী সেবা প্রাপ্তি, বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারে ৪৩টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের বাজেটে নারী উন্নয়ন ও নারী অগ্রগতির বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে নয়টি, উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণে নয়টি এবং সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধিতে পঁচিশটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ কাজ করছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ৯২,৭৬৫ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ২৭.২৫ শতাংশ ৪০টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। বর্তমান ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে নারী উন্নয়নে ১,১২,০১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা মোট বাজেটের ২৭.৯৯ শতাংশ। ৪৩টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের মাধ্যমে এ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৬-২০) জেন্ডার সম্পৃক্ত রূপকল্প হলো ‘এমন একটি দেশ বিনির্মাণ করা যেখানে পুরুষ ও নারীর সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে সমান অবদানকারী হিসেবে নারীর মর্যাদা স্বীকৃতি দান করা হবে’। এর কার্যকর উদ্দেশ হলো আত্মনির্ভরশীল হিসেবে নারীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং উন্নয়নমূলক ও প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্যমূলক প্রতিবন্ধকতার নিরসন ঘটানো। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জেন্ডারসমতাসহ নারীর ক্ষমতায়ন সংশ্লিষ্ট এজেন্ডার মূলে রয়েছে এমন ধরনের কৌশল ও কর্মব্যবস্থা অনুসরণ করা যা শুধু নারীর সক্ষমতাই বাড়াবে না, সে সঙ্গে সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা হ্রাসের মতো সমস্যা মোকাবিলা করবে। সে লক্ষ্যে সরকার নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করছে। দেশের সব নারীর উচিত সরকারের এ কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে নিজে ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা।