নিরাপদ পোশাক শিল্পের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ

বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে তৈরি পোশাকের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয় পশ্চিমা দেশগুলোতে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক রাখতে সাধারণত বছরের শেষদিকে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে কাজের চাপ একটু বেশিই থাকে। এ রকম জরুরি রফতানি আদেশের পোশাক সরবরাহের প্রয়োজনে দিন-রাত টানা কাজ চলছে গাজীপুরের কিউ অ্যান্ড কিউ কারখানায়। গত ১৬ আগস্ট রাত সোয়া ৩টায় কয়েকজন শ্রমিক কিছুটা ভয় পেলেন। কাপড় শুকানোর  যন্ত্র ডায়ার মেশিন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। একপর্যায়ে আগুন। ফায়ার অ্যালার্মও বেজে উঠল। কিন্তু কারও মধ্যে তেমন আতঙ্ক বা হুড়াহুড়ি নেই। শ্রমিকদের একজন ‘হেলপ লাইন’-এ পৌঁছালেন খবরটা। বাকি শ্রমিকরা দ্রুত নিরাপদে কারখানা থেকে বেরিয়ে অ্যাসেম্বলি পয়েন্টে এসে জড়ো হলেন। হেলপ লাইনের বার্তা দ্রুত চলে যায় বাংলাদেশের পোশাক খাতের সংস্কারবিষয়ক জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটির (অ্যালায়েন্স) কার্যালয়ে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মুহূর্তেই ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে দমকল বাহিনী হাজির। সম্পদ ও প্রাণহানির আগেই আগুন নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। এভাবেই অগ্নিনিরাপত্তায় মৌলিক প্রশিক্ষণ পাওয়া এ শ্রমিকরা নিজেদের রক্ষা করলেন আরও একটি বেদনাদায়ক তাজরীন ট্র্যাজেডি থেকে।

জরুরি মুহূর্তে করণীয় নিয়ে এ রকম মৌলিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এখন বেশিরভাগ পোশাক কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী। যে কোনো ঝুঁকিতে নিজেদের করণীয় জানেন তারা। কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা উন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের কাজেও সাফল্য এসেছে এ পদ্ধতি। এখন মজুরি আদায়সহ যে কোনো অধিকার আদায় কিংবা জটিলতা নিরসনে তাৎক্ষণিক প্রতিকার মিলছে। কয়েকটি মোবাইল নম্বর সংবলিত একটি হেলপ লাইন কার্ড এখন শ্রমিকদের হাতে হাতে। এই নম্বরে বিনা খরচায় সপ্তাহের ৭ দিন ২৪ ঘণ্টায় যে কোনো অভিযোগ জানাতে পারেন শ্রমিকরা। অভিযোগের ভিত্তিতে সমাধানও দেওয়া হচ্ছে। এ রকম নিরাপত্তা উদ্যোগের ফলে রানা প্লাজা ধসের পর আর কোনো বড় দুর্ঘটনা দেখতে হয়নি।

অ্যালায়েন্স সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ২ লাখ ১৬ হাজার সমস্যার কথা এসেছে হেলপ লাইনে। এর মধ্যে কারখানা ভবনে ফাটলসহ কাঠামো দুর্বলতা, অগ্নিদুর্ঘটনা ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত অভিযোগই বেশি। কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়ে দুর্ঘটনা এড়ানো এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। অ্যালায়েন্সের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং এক সময়ের ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি সমকালকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের আগে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। সংস্কারের ফলে এ দেশের পোশাক শিল্প এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ। রানা প্লাজা ধসের আগে এ ধরনের পরিবেশ থাকলে এত বড় ট্র্যাজেডি হয়তো এড়ানো যেত।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর অদূরে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ফাটল শনাক্ত হওয়া ভবনটি ব্যবহার না করার সতর্কতা উপেক্ষা করার ফলে মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতে ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৬ শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক। এ দুর্ঘটনাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুর্ঘটনার পর দেশি-বিদেশি ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে পোশাক খাত। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে শ্রমিক সংগঠন। বাংলাদেশ থেকে পোশাক না নেওয়ার ঘোষণা দেয় কয়েকটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। ‘বাংলাদেশে তৈরি পোশাক বিক্রি করা হয় না’- কয়েকটি ব্র্যান্ডের শোরুমের সামনে এ রকম ব্যানার টানানোর ঘটনাও ঘটে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বড় সংকটে পড়ে।

কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান দুই বাজার ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার (এনপিটি) কঠোর নজরদারিতে আসে ছোট-বড় প্রায় সাত হাজার পোশাক কারখানা। শুরু হয় ব্যাপক সংস্কার অভিযান। সব কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক ত্রুটি শনাক্ত করা হয়। সংশোধনের অযোগ্য ত্রুটি থাকা এবং ব্যয়বহুল ব্যাপক সংস্কার কাজে তাল মেলাতে না পারায় অন্তত দুই হাজার কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্রেতাদের দুই জোট, সরকার, জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) কয়েকটি দাতা সংস্থা এবং পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অংশগ্রহণ এবং তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া সংস্কার কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে। গতকাল পর্যন্ত অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোর ৮৮ শতাংশ ত্রুটি সংশোধনের কাজ শেষ হয়েছে। অ্যাকর্ডের এ হার ৮৪ শতাংশ। দুই জোটের পাঁচ বছরের চুক্তি শেষে আজীবন সংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকার রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করেছে। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স, সুশীল সমাজ, মালিক ও শ্রমিক- সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আরসিসি গঠিত হয়েছে। আরসিসি এখন দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। দীর্ঘ ধারাবাহিক এ সংস্কারের ফলে বাংলাদেশ এখন নিরাপদ পোশাক কারখানার বিশ্ব মডেল হিসেবে সম্মান পাচ্ছে। অনেক দেশ এখন বাংলাদেশের সংস্কার মডেল অনুসরণ করতে চায়।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সবুজ কারখানা এখন বাংলাদেশে :নিরাপত্তা উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশসম্মত কারখানা নির্মাণেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষতম। সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা এখন বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) পরিবেশ সুরক্ষার বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো মানের কারখানাকে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (লিড) সনদ দেয়। বাংলাদেশের সর্বাধিক সংখ্যক ৬৭টি কারখানা এ সনদ পেয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫০টি পরিবেশবান্ধব কারখানা ইন্দোনেশিয়ার। প্রতিবেশী ভারতে এ ধরনের কারখানা রয়েছে মাত্র পাঁচটি। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ইউএসজিবিসির এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের প্রধান গোপালকৃষ্ণ পি এসব তথ্য জানিয়ে বলেছেন, অচিরেই বাংলাদেশের আরও ২৮০টি পোশাক কারখানা লিড সনদ পেতে যাচ্ছে।

সনদ পাওয়া কারখানাগুলো ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি ও জ্বালানি সাশ্রয় করতে সক্ষম। যেখানে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা কম হয়। কারখানা ভবনের স্থাপত্য কাঠামোর কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও হতাহত কম হয়। তবে এ জন্য বিনিয়োগ করতে হয় কয়েক গুণ বেশি। জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সতর্ক। অসংখ্য সবুজ কারখানা এখন গড়ে উঠছে দেশে। নতুন সব কারখানাই এ প্রক্রিয়ায় নির্মিত হচ্ছে। সংস্কারে পুরনো কারখানাগুলোও একই পথ ধরেছে। এতে প্রাথমিক ব্যয় বাড়লেও প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বেড়েছে। বিশ্বের কাছে নিরাপদ এবং পরিবেশসম্মত পোশাক কারখানার রোলমডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। যুগ যুগ ধরে গোটা জাতি এর সুফল পাবে।

সংস্কারে উন্নয়নের এই বাংলাদেশ মডেল এখন অনেক দেশই ধার করতে চায়। বিজিএমইএ সভাপতির মতো মরিয়ার্টিও মনে করেন বাংলাদেশ এখন নিরাপদ পোশাক শিল্পের রোল মডেল। সমকালকে তিনি বলেন, অনেক দেশই এখন বাংলাদেশের মডেল অনুসরণ করতে চায়। তারা অন্য দেশেও বাংলাদেশের মডেল অনুসরণে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। অন্তত ২০টি বড় বড় ব্র্যান্ড কয়েকটি দেশে এ ধরনের সংস্কারের পাইলট প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।

সংস্কারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে :  সংস্কার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা একটা বড় চ্যালেঞ্জ এখন। অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম শেষ হলে সংস্কারের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে কিছুটা সংশয় হয়েছে। গতানুগতিক সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরসিসি দিয়ে বিশ্বমানের তদারকি সম্ভব কি-না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বাণিজ্য বিশ্নেষকরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, সংস্কারের অগ্রগতি নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। উদ্যোক্তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন নিরাপত্তা কিংবা শ্রমিক সুস্বাস্থ্য বাড়তি ব্যয় নয়, বরং মুনাফা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ নতুন করে আবার মেরামত করা সম্ভব হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। আবার জাতীয় কর্মপরিকল্পনার অধীনে থাকা দেড় হাজার কারখানার সংস্কার কাজ শুরু করাটাও অত্যন্ত জরুরি। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল কমপ্লায়েন্সের নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আরসিসির মাধ্যমে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।