পৃথিবীর অনেক দেশে মাংসের চাহিদা মেটাতে এখন ব্যাপক আকারে টার্কি মুরগির বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশে শান্ত প্রকৃতির এই প্রাণীর পরিচিতি তেমন নেই। শৌখিনতার গণ্ডি পেরিয়ে কোনো কোনো ব্যক্তি ইদানীং বাণিজ্যিকভাবেই টার্কি পালনে এগিয়ে এসেছেন। নিজেদের বেকারত্বও ঘুচিয়ে অন্যদেরও সহযোগিতা করছেন। ঢাকার সাভারে আমিনুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং তাঁর দুই বন্ধু সোহেল ও বাঁধন তেমনই তিন উদ্যোক্তা। তাঁরা গড়ে তুলেছেন টার্কি খামার ‘বাঁধন এগ্রোফার্ম’। এই তরুণ তুর্কি এখন অন্য উদ্যোক্তাদের দিশারিও বটে।
বাঁধন এগ্রোফার্মের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম উজ্জ্বল জানান, তিনি পোল্ট্রি ফিডের একটি প্রতিষ্ঠানে সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করতেন। বছর চারেক আগে এক পোল্ট্রি ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেলে উজ্জ্বল ওই জায়গাটি ভাড়া নেন। পরে সেখানে তিনি ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগি পালন শুরু করেন। তখন পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে ‘এগ্রোটেক ফিডস লিমিটেড’-এর কনসালট্যান্ট ডা. মাকসুদুর রহমান ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের প্রভাষক ডা. জামিনুর রহমান তাঁকে টার্কি পালনে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁদের পরামর্শে তিনি টার্কি পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তাঁর দুই বন্ধু সোহেল ও বাঁধন। তাঁরা তিনজন মিলে গড়ে তোলেন টার্কি খামার বাঁধন এগ্রোফার্ম।
আমিনুল জানান, ২০১৫ সালের দিকে তাঁরা সাতক্ষীরা থেকে প্রতিটি ৬০০ টাকা দরে এক মাস বয়সী ১০০টি টার্কির বাচ্চা ক্রয় করে আনেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় ৫০ বাচ্চা শুরুতেই মারা যায়। তখন তারা তিন বন্ধু কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে ২০টি বাচ্চা বিক্রি করে দেন। পরে তিনি ডা. মাকসুদুর রহমান ও ডা. জামিনুর রহমানের শরণাপন্ন হলে তাঁরা তাঁকে টার্কি পালনের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় শিখিয়ে দেন। বর্তমানে তাঁর এই খামারে স্টোকস, নরফোল ব্রোঞ্চ, রেড বার্বন ও রয়েল পাম নামে চার প্রজাতির প্রায় ২৫০টি টার্কি রয়েছে। তিনি আরো জানান, তাঁদের ফার্মে প্যারেন্টস স্টোকস প্রজাতির ১৭০ টার্কির মধ্যে ১২০টিই এখন ডিম দিচ্ছে। প্রতিটি টার্কি বছরে অন্তত ১০০ ডিম দেয়। আর ডিম প্রতি হালি সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে এখন চাহিদা বেশি থাকায় তাঁরা ভাড়ায় ইনকিউবিউটরে ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করেন; যেখানে এক দিন বয়সী একটি টার্কির বাচ্চার বর্তমান বাজারমূল্য ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ধামরাই, গাজীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁদের এখানে টার্কির বাচ্চা কিনতে আসে অনেকে। বর্তমানে তাঁদের ফার্মে প্রতি সপ্তাহে ৬০০ থেকে ৭০০ বাচ্চা উত্পাদিত হলেও তিনি গ্রাহকদের চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করতে পারছেন না। তাই ব্রয়লার ও অন্যান্য মুরগি পালনের চেয়ে টার্কি পালন অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে শুধু টার্কি পালন করবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই ব্যবসায়ী।
আমিনুল ইসলামের ব্যাবসায়িক অংশীদার মো. সোহেল জানান, ব্রয়লার, ককের চেয়ে টার্কি পালনে খরচ অনেক কম। প্রতিটি টার্কি দিনে মাত্র পাঁচ টাকা মূল্যের ১২০ গ্রাম খাবার (পোল্ট্রি ফিড) খেয়ে থাকে। পাশাপাশি কলমি শাক, সবুজ ঘাস, কচুরিপানা, বাঁধাকপিও টার্কির পছন্দের খাবার। তিনি বলেন, টার্কির মাংস খুবই সুস্বাদু এবং কোলেস্টেরল নেই বললেই চলে। এ কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগে তাঁদের খামারে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা কেজি দরে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ কেজি মাংস বিক্রি হতো। আর এখন তা বেড়ে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কেজি থেকে তিন হাজার কেজি মাংস বিক্রি হয়। সব মহলে যেহেতু টার্কির মাংস খাদ্য হিসেবে সেভাবে পরিচিতি পায়নি, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতো উচ্চবিত্তরাই তাঁদের নিয়মিত ক্রেতা। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তাঁর আড়াই শ টার্কির জন্য খরচ মাত্র দেড় লাখ টাকা। আর লাভ কয়েক গুণ বেশি। তিনি বলেন, এই বাধন এগ্রোফার্ম থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করে টার্কি পালনে সফলতা পেয়েছে মানিকগঞ্জের কাজী মোজাফফর হোসেন, আশুলিয়ার আনোয়ার হোসেন ও রুবায়েত, ধামরাইয়ের মো. দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকেই।
আমিনুল ও সোহেল বলেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারছেন যে টার্কি পালন অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক। যদিও রানীক্ষেত, গামব্রু ও ফাউলপক্স নামের রোগে আক্রান্ত হয় টার্কি। তবে ছয়, সাত, ১৫ ও ৩০ দিন বয়সে চারটি ভ্যাকসিন দিলে এ রোগের সংক্রমণ অনেকটাই রোধ করা যায়।
এই দুই ব্যবসায়ী মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে টার্কি পালন করে একদিকে দেশের বেকারত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব; অন্যদিকে দেশের মাংসের ও প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে টার্কির মাংস বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।