আমাদের দেশের রাবার শিল্প ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে রাবার শিল্প ইতোমধ্যে বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশের রাবার শিল্প মালিকেরা এখন লাভের মুখ দেখছেন। দেশে উত্পাদিত রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
রাবার শিল্প মূলত বিদেশ থেকে এদেশে এসেছে। ১৯১০ সালের কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে রাবার গাছের চারা এনে চট্টগ্রামে বারমাসিয়া ও সিলেটের আমুচা চা বাগানে লাগানো হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৫৪ সালের দিকে বন বিভাগ টাঙ্গাইলের মধুপুর চট্টগ্রামের হাজারীখীল ও তেঁতুলিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু রাবার চারা রোপণ করে। এভাবে আমাদের দেশে রাবার চাষের গোড়াপত্তন ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের দিকে বাংলাদেশে রাবারের বাণিজ্যিক চাষে সম্ভাবনা যাচাই করার জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মিঃ ইউলিয়াম লয়েডকে দায়িত্ব দিলে তিনি তার সমীক্ষায় এদেশের জলবায়ু ও পাহাড়ী এলাকার মাটি বাণিজ্যিক রাবার চাষের উপযোগী বলে এর চাষের অনুকূলে রিপোর্ট দেন। তার সুপারিশের ভিত্তিতে বন বিভাগ ১৯৬০ সালে ৭১০ একরের একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের রামু ও চট্টগ্রামের রাউজানে যথাক্রমে ৩০ এবং ১০ একর বাজার সৃজনের মাধ্যমে এদেশের বাণিজ্যিক রাবার চাষ শুরু করে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার চাষ হচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রামু, রাউজান, ডাবুয়া, হলুদিয়া, কাঞ্চননগর, তারাখো, দাঁতমারা, সিলেটের ভাটেরা, সাতগাঁও, রূপাইছড়া, শাহাজী বাজার, ময়মনসিংহের মধুপুর, শেরপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এলাকাসহ লামার বিস্তীর্ণ এলাকা। সারাদেশে ১৩০৪ টি বেসরকারি রাবার বাগান রয়েছে এবং ৩২,৬২৫ একর জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ২৪,০০০ মেট্রিক টন রাবার উত্পন্ন হচ্ছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ছয়’শ কোটি টাকা।
২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে রাবারের চাহিদা ৩% হারে বেড়েই চলেছে। যার চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৭%। বর্তমানে রাবার দিয়ে ১ লক্ষ ২০ হাজার ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। রাবার দিয়ে প্রধানত গাড়ির চাকার টায়ার, টিউব, জুতার সোল, সেন্ডেল, ফোম, রেক্সিন, হোসপাইপ, গাম, খেলনা, শিল্প-কারখানার দ্রব্যসামগ্রী ও চিকিত্সা শাস্ত্রের বিভিন্ন সামগ্রীসহ গৃহস্থালী কাজে ব্যবহূত বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ রাবার চাষে নবীন হলেও এর ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ সহায়ক ও আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে রাবার চাষের গুরুত্ব অপরিসীম।
বর্তমানে প্রতি বাগানে ২৫ একর জায়গায় রাবার চাষ করা হচ্ছে। সেখানে এর পরিধি বৃদ্ধি করে ১০০ একর করতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশের যেসব স্থানে এখনো পর্যন্ত রাবার চাষ করা হয়নি সেসব স্থানে রাবার বাগান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। রাবার প্রসেসিং করার জন্য পৃথক পৃথক প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। এতে করে রাবারের উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে এবং মানসম্মত রাবার পাওয়া যাবে। রাবার গাছকে প্রক্রিয়াজাত করে মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। রাবার শিল্পের সাথে রাবার গাছের কাঠও দেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। এতে করে এই সেক্টরে আগামী দশ বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। রাবার চাষ আর্থিকভাবে লাভজনক করার জন্য রাবার বাগানের চারপাশে বনজ, ফলদ, বাগানের ভেতরে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরুর খামার গড়ে তোলা সম্ভব।
আমাদের দেশের রাবার শিল্প প্রসঙ্গে আলাপ হয় রাবার বাগান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ কামাল উদ্দীনের সাথে। তিনি বলেন, রাবার বাগান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে রাবার শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের রাবারের রূপকল্পের ১ম অধ্যায় বাস্তবায়ন করা হবে। বিদ্যমান বাগানগুলোর উত্পাদন দেশীয় শিল্পের জন্য বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ অধিক কাঁচা রাবার সরবরাহ করার পরও দুই’শ কোটি টাকার রাবার রপ্তানি করা সম্ভব। রূপকল্পের নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এ খাত থেকে সম্ভব প্রতিবছর অতিরিক্ত সাত’শ কোটি টাকার রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা। তবে রাবার উত্পাদকদের কিছু দাবি-দাওয়াও আছে। যেমন- কাঁচা রাবারকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করা, কাঁচা রাবার তথা সীট রাবারের উপর থেকে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করা, একতরফাভাবে বাতিলকৃত রাবার প্লটসমূহ রাবার বোর্ড এর আওতায় আনা, রাবার বাগান এলাকায় সব বাগানে সরকারি খরচে টিউবওয়েল স্থাপন করা, রাবার সীট পরিবহনে পুলিশী হয়রানি বন্ধ করা, রাবার বাগান সৃজন ও উত্পাদনে সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান করা, স্বল্প মূল্যে সার বরাদ্দ দেওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশের বাজারে আমাদের দেশের রাবারের চাহিদা সৃষ্টির ব্যাপারে নিতে হবে বিশেষ উদ্যোগ। বস্তুত আমাদের দেশের রাবার শিল্পের জন্য সোনালি দিন অপেক্ষা করছে।