অটিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী তারা

রফিদ আহসান। প্রায়স বিশেষায়িত স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সে। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও ইচ্ছাশক্তির জোরে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে বিশ্ব দরবারে রেখেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর। পড়ালেখার পাশাপাশি কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়েও বেশ দক্ষ সে। ছবি আঁকা থেকে শুরু করে কম্পিউটারে ওয়েব ডিজাইন, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেলসহ কম্পিউটারের অনেক জটিল কাজ করতে পারে দক্ষতার সঙ্গে। ভালো পারদর্শিতার জন্য কম্পিউটার ও আইসিটি প্রতিযোগিতায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার।

চায়নাতে অনুষ্ঠিত আইসিটি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিল আইসিটি আইকন রাফিদ। ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন রফিদ। বাবা ফকরুল আহসান ও মা রশিদা সুলতানার প্রথম সন্তান সে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো সাফল্যের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। সোমবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।

শুধু রাফিদই নয়, প্রতিবন্ধিতার কাছে হার না মেনে ভালো সাফল্য করায় আরও দুজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নকে পুরস্কার দেয়া হবে।

তাদের মধ্যে একজন ফারহান সায়ীদ তানিশা (অনন্ত)। ১৯৯৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সাইদ নাসিম এবং নাসরিন আহমেদের ঘরে জন্ম নেয় অনন্ত। বর্তমানে স্কুল ফর গিফটেড চাইল্ড স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সে। ছবি আঁকায় বেশ পারদর্শী অনন্ত। এছাড়াও নাচ, গান ও কম্পিউটারেও তার ভালো দক্ষতা আছে। ২০১৩ সালে তার আঁকা ছবি প্রধানমন্ত্রীর ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডে স্থান পায়। যার কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাকে তিন লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হয়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ক্যালেন্ডারে অনন্তের আঁকা দুটি ছবি স্থান পায়। বার্জার আয়োজিত ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পরপর তিনবার পুরস্কার জেতে। এছাড়া টেলিভিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রামেও অংশ নেয় অনন্ত। গত ছয় বছর থেকে ছায়ানটে গান শিখছে।

অন্য একজন হলেন তাহমিদ হুসাইন আকিফ। ১৯৯৮ সালের ২৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন আকিফ। তার বাবা কবির হোসেন এবং মা সিরাত মুনিয়া চৌধুরী। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তার স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। যেকোনো সালের তারিখ বললে আকিফ সেদিন কি বার তা অনাসায়ে বলে দিতে পারে।

এছাড়া ২০১০ সালে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করে পুরস্কার অর্জন করে। সে স্পেশাল অলিম্পিকসে হাঁটায় প্রথম স্থান অধিকার করে এবং ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ডে ছবি এঁকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার পায়। এছাড়াও নাচ ও খেলায় পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে আকিফ।

সোমবারের অনুষ্ঠানে তিনটি ক্যাটাগরিতে তিন জন করে মোট নয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদানের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।

পুরস্কৃত হচ্ছেন যে তিনজন

প্রতিবন্ধিতায় বিশেষ অবদায় রাখায় যে তিন ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে তাদের একজন ড. শিরিন জামান মুনির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকন্সিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পেশাল এডুকেশনে মাস্টার্স ডিগ্রি, স্পেশাল এডুকেশন/সাইকোলোজিতে পিএইচিডও অর্জন করেন। দেশে ও বিদেশে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক সভা-সেমিনার অনেক প্রেজেন্টেশন করেন। তিনি সুচনা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য। এছাড়া প্রয়াস ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ এনডিডি বিষয়ক বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন সাবিনা হোসেন। সোসাইটি ফর দি ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেনের (সোয়াক) প্রতিষ্ঠাতা অভিভাবক সদস্য ও পরিচালক (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ)। তিনি ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও ফিনল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে অটিজম বিষয় প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অটিজম বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। অটিজম বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জন সচেতনামূলক কর্মশালা, সভা, সেমিনারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অটিজমে অবদানের জন্য তিনি ডেমোক্রেসি ওয়াচ, এশিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও বেসিস এর পুরস্কার লাভ করেন।

তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন অধ্যাপক ডা. নায়লা জামান খান। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিভাগের এই অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিশেষ শিক্ষায়  পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি অটিজম উত্তরণের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন।

আন্তর্জাতিক অটিজম বিশেষজ্ঞ মিস সায়মা ওয়াজেদের সভাপতিত্বে গঠিত অটিজম ও স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্য বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য তিনি। অধ্যাপক নায়লা জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে সহায়তাসহ এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ম্যানুয়াল অনুবাদ করছেন যা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পড়ালেখায় অবদান রেখেছেন।

পুরস্কৃত হচ্ছেন যেসব প্রতিষ্ঠান

‘বিশেষ শিশু বিশেষ অধিকার’- এ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘প্রয়াস বিশেষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অটিজমসহ অন্যান্য সকল প্রতিবন্ধী শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ এবং পরবর্তীতে তাদেরকে সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে‘ প্রয়াস বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অটিজমসহ সর্বস্তরের বিশেষ শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব শিখন পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রতিষ্ঠানটির বহুমুখী ও সুসমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম অনন্য মডেল হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে।

নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন

প্রকৌশলী ঝুলন দাসের উদ্যোগে ডা. বাসন মহুরী এবং কয়েকজন অভিভাবক ও সমমনা ব্যক্তির প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোডে ২০১০ সালের জুলাই ‘নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ফাউন্ডেশন ‘নিষ্পাপ অটিজম স্কুল’ নামে একটি স্কুল পরিচালনা করছে, যার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৬৫ জন। শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন ২২ জন। এছাড়া ফাউন্ডেশনটি একটি ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার এবং একটি অটিজম হোম পরিচালনা করছে। সাংস্কৃতিক ও স্কাউটিং কার্যক্রমে অটিজম শিশুদের সম্পৃক্তকরণ ও উন্নয়নে  ‘নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন’ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

প্যারেন্টস ফোরাম ফর ডিফারেন্টালি অ্যাব (পিএফ ডিএ)

২০১১ সালের সাউথ এশিয়ান কনফারেন্স অন অটিজমের মাধ্যমে কয়েকজন অভিভাবক মিলে প্যারেন্টস ফোরাম ডিফারেন্টস অ্যাবল (পিএফ ডিএ) প্রতিষ্ঠা করেন। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অটিজম এবং অন্যান্য বিকাশ সংক্রান্ত অক্ষমতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জাতীয় উন্নয়নে অংশীদার করা এবং সমাজের সকল ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে। এছাড়া অটিজম এবং অন্যান্য বিকাশ সংক্রান্ত অক্ষমতায় আক্রান্তদের অধিকার অর্জন, তাদের জীবনমান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রকল্প গ্রহণে  উৎসাহিত  করা, মূলস্রোতের অংশ হিসেবে গড়ে তোলা, তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করা এবং নিজ নিজ পরিবেশে বসবাসের জন্য যতদূর সম্ভব উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংগঠনটি।