সরকারি চিনিকল লাভজনক করতে সরকারের উদ্যোগ

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ২০০২ সালে চিনি আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর থেকেই বিপাকে পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো। দেশে উত্পাদিত চিনির তুলনায় আমদানি করা চিনির মূল্য কম হওয়ায় অবিক্রীত থাকছে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার চিনি। লোকসান গুনতে গুনতে রুগ্ণ হয়ে পড়ে চিনিকলগুলো। চিনিকলগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় চিনির পাশাপাশি অন্য পণ্য উত্পাদনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

জানা গেছে, চিনিকলগুলোকে লাভজনক করতে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি চিনিকলে বিদ্যুৎ উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপন, চিনিকলগুলোর আধুনিকায়ন, ডিস্টিলারি ইউনিট স্থাপন, জৈব সার উত্পাদন, মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট, জুস প্লান্ট স্থাপনসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সুগার মিলগুলোতে বিদ্যুৎ উত্পাদন কেন্দ্র বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে সুগার মিলগুলো নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে অবশিষ্ট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের মাধ্যমে বড় অঙ্কের মুনাফা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা বছরে ১৫-১৬ লাখ টন। এর বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের উত্পাদন মাত্র দুই লাখ টন। আর বেসরকারি পাঁচটি রিফাইনারির উত্পাদন ক্ষমতা ৩২ লাখ টন। বর্তমানে দেশের প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়। আর সরকারি চিনিকলগুলোর উত্পাদিত চিনির ব্যয় গড়ে প্রতি কেজি ১২০ টাকা। আখ থেকে চিনি আহরণের নিম্নহার, পর্যাপ্ত আখ সরবরাহ না থাকা ও মাড়াই দিবস কমে যাওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর উত্পাদন খরচ বাড়ছে। আর উত্পাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় একসময়ের লাভজনক চিনিশিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে।

বিএসএফআইসি সূত্র জানায়, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে চিনিকলগুলোতে ব্যাগাসে (চিনি রস আহরণের পর থেকে যাওয়া ছোবড়া) থেকে কোজেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উত্পাদন করা। এ জন্য নর্থ বেঙ্গল ও ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে বিদ্যুৎ প্লান্ট বসানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব প্লান্ট থেকে গড়ে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন সম্ভব। একটি চিনিকলে সর্বোচ্চ তিন মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন। নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে বাকি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে বড় অঙ্কের আয় করতে পারবে সুগার মিলগুলো। এ ছাড়া কুষ্টিয়া ও জয়পুরহাট সুগার মিলে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট বসানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার বাজেট করা হয়েছে, যা এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত হয়ে আছে।

চিনিকলগুলোতে আখ থেকে চিনি উত্পাদন করতে গিয়ে উত্পন্ন উপজাত মোলাসেস বা ঝোলাগুড় সীমিত পরিমাণে স্পিরিট উত্পাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ঝোলাগুড় থেকে স্পিরিট উত্পাদন হয় শুধু কেরু অ্যান্ড কোং চিনিকলের সঙ্গে সংযুক্ত ডিস্টিলারিতে। এ ডিস্টিলারিতে মোলাসেস থেকে অ্যালকোহল ছাড়াও এসিটিক এসিড, রেকটিফাইড স্পিরিট উত্পাদন করা হয়। কেরু কম্পানির উত্পাদিত লিকার উন্নতমানের হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি চিনি উত্পাদনে বড় অঙ্কের লোকসান করলেও লিকার উত্পাদনের মাধ্যমে মুনাফায় রয়েছে। এ কারণে আরো দুটি চিনিকলে আধুনিক ডিস্টিলারি ইউনিট বসানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ দুটি ডিস্টিলারি ইউনিট বসানো হলে শুধু লিকার ও রেকটিফাইড স্পিরিট উত্পাদনের মাধ্যমে মুনাফায় ফিরতে পারবে সংশ্লিষ্ট দুই চিনিকল। এ ছাড়া কেরু অ্যান্ড কম্পানি আধুনিকায়নে ১৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কম্পানির ডিস্টিলারি ইউনিট অটোমেশন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিএসএফআইসির সচিব এ বি এম আরশাদ হোসেইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিটি চিনিকলের জায়গাগুলোর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের জন্য কাজ চলছে। এখন আমরা শুধু চিনিতেই সীমাবদ্ধ থাকব না। জুস ও মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট, বেশ কয়েকটি চিনিকলে ডিস্টিলারি ইউনিট স্থাপন, পর্যায়ক্রমে সব চিনিকল আধুনিকায়ন করা, বিদ্যুৎ উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। পাঁচটি মিলে বিদ্যুৎ উত্পাদন কেন্দ্র করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে একটিতে কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।’

জানা গেছে, রাজশাহী চিনিকলে আধুনিক জুস ফ্যাক্টরি করা হবে। গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে (রংপুর সুগার মিলস) একসঙ্গে ১৮০০ একর জায়গা রয়েছে, যেখানে ১৯টি বড় পুকুর রয়েছে। সম্প্রতি সেগুলো উদ্ধার করে বাণিজ্যিকভাবে মত্স্য চাষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি সরকারি চিনিকলগুলোতে র-সুগার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হবে বলেও জানা গেছে। এ জন্য কারখানাগুলোতে রিফাইনারি স্থাপন করা হবে। এরই মধ্যে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে রিফাইনারি স্থাপনের কাজ চলছে। এ ছাড়া জিলবাংলা সুগার মিলসহ আরো তিনটি চিনিকলকে র-সুগার আমদানির অনুমতি দেওয়া হতে পারে। ফলে দেশীয় চিনি উত্পাদনের পাশাপাশি র-সুগার পরিশোধন করে সাদা চিনি উত্পাদন করলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর উত্পাদন খরচ কমবে।