দেশ স্বাধীনের বছরে ধান, আলু ও গম মিলিয়ে মোট ১ কোটি ১৮ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যা পর্যাপ্ত ছিল না। স্বাধীনতার পর মানুষের মুখে দু’বেলা অন্ন তুলে দেওয়াই ছিল নতুন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। চাহিদা মেটাতে তখন বিদেশি সহায়তা ও আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো। এরপর নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ পার করেছে সাড়ে চার দশক। জমির পরিমাণ না বাড়লেও বীজ ও চাষে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং সরকারের নীতি সহায়তায় দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ধান, পাট, গম, আলুর চাষ ও উৎপাদনের ৪৫ বছরের (১৯৭০-৭১ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত) পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ধান, গম ও আলুর উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন। সংস্থাটির বিভিন্ন সময়ে কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাতের জরিপে উঠে আসা পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। বিবিএসের মহাপরিচালক আমীর হোসেন সমকালকে বলেন, দেশে মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। অপরদিকে ফসলের উৎপাদনও বাড়ছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব সহজে যে দেশের ফসল উৎপাদন এ পর্যায়ে এসেছে, তা নয়। প্রায় প্রতি বছরেই ছোটখাটো বন্যা-ঘূর্ণিঝড় লেগে থাকে। এ ছাড়া প্রতি দশকে একবার করে বড় বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। গত শতাব্দীর শেষদিকে এসে যে সবুজ বিপ্লব শুরু হয় তার সদ্ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের কৃষি খাত। কৃষক সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন আধুনিক চাষাবাদের সঙ্গে। যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা দেখিয়েছেন অন্য খাতের চেয়ে বেশি। এরই ফল আজকের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বায়েস সমকালকে বলেন, প্রধানত চারটি কারণে বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন বেড়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং চাষের সহায়ক সেচ ও সার সুবিধা। এ ছাড়া রয়েছে সরকারের সহায়ক নীতিমালা। সরকার কৃষির জন্য আমদানি উদারীকরণ করেছে। সারের বাজারে বেসরকারি খাতের অন্তর্ভুক্তি, কৃষি ভর্তুকি এবং বিনিয়ন্ত্রণ এ খাতকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। এখন কৃষকরা জ্ঞানভিত্তিক চাষ করছেন, যা আগে হতো শুধু সম্পদভিত্তিক। পাশাপাশি বাজারমুখিতা বেড়েছে। আগে কৃষকরা শুধু নিজের চাহিদা পূরণে চাষ করতেন। এখন বিক্রির জন্যও চাষ করছেন।
ধান :১৯৭০-৭১ সালে দেশে ৯৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন, আউশ ও বোরো ধানের চাষ হয়। কৃষকরা মোট ধান উৎপাদন করেন ১ কোটি ৮ লাখ ৬৮ হাজার টন। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১ দশমিক শূন্য ৯৬ টন ধান উৎপাদন হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১৪ লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। প্রতি হেক্টরে গড়ে উৎপাদন হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৪১ টন।
আউশ চাষ কমে বেড়েছে বোরো চাষ। আমনের চাষ প্রায় অপরিবর্তিত। তবে সব ধানেই একরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। ‘৭১ সালে প্রতি হেক্টরে দশমিক ৮৯ টন আউশ হয়, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয়েছে ২ দশমিক ২২ টন। ১৯৭০-৭১ সালে প্রতি হেক্টরে গড়ে ১ টন করে আমন উৎপাদন হয়, যা এখন প্রতি হেক্টরে হচ্ছে ২ দশমিক ৩৮ টন। ১৯৭০-৭১ সালে সারাদেশে ৯ দশমিক ৮২ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়। ওই সময় প্রতি হেক্টরে গড়ে উৎপাদন হয়েছে ২ দশমিক ২৩ টন করে। ২০১৪-১৫ সালে এসে বোরো চাষ হয়েছে ৪৮ দশমিক ৪০ লাখ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৬ টন।
আলু :স্বাধীনতার বছর দেশে মাত্র দুই লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। তখন সারাদেশে ৮ লাখ ৪৯ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় ৩ দশমিক ২৮ টন। এরপর আলু চাষ হঠাৎ করেই কমে যায়। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আলু চাষ হয়েছে দেড় লাখ হেক্টরের মধ্যে। ২০০০ সালের পর আলুর চাষ বাড়তে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৪ লাখ ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৯ দশমিক ৬৪ টন করে মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৯২ লাখ ৫৪ হাজার টনে।
গম :স্বাধীনতার বছর দেশে এক লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়। উৎপাদন হয় এক লাখ টন। প্রতি হেক্টরে ৮৭০ কেজি করে গম উৎপাদন হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সারাদেশে ৪ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে গমের চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩ টন করে উৎপাদন হওয়ায় মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৪৮ হাজার টনে।
পাট :১৯৭০-৭১ সালে দেশে ৯ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। মোট উৎপাদন ছিল ৬৮ লাখ বেল। প্রতি হেক্টরে গড়ে সাড়ে ৭ বেল পাট উৎপাদন হয়। ৪৫ বছর পর এসে জমির হিসাবে মোট চাষ কমলেও উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সারাদেশে ৬ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। মোট পাট উৎপাদন হয়েছে ৭৫ লাখ বেল। প্রতি হেক্টরে ১১ বেলের বেশি পাট উৎপাদন হয়েছে।