ব্যাংকের শাখা খোলা ব্যয়বহুল। তাই শাখা না খুলে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বছরতিনেক আগে শুরু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। এখানে বাড়তি চার্জ নেই। চেকের মাধ্যমে টাকা তোলার পাশাপাশি ডেবিট কার্ডও ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এই ব্যাংকিংয়ের সেবার তালিকায় বর্তমানে যুক্ত হয়েছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নতুন এই ব্যাংকিং ধারণাটি। ক্রমাগত বাড়ছে গ্রাহক, বাড়ছে লেনদেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের আট লাখ ৭৩ হাজার গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। এসব হিসাবে জমাকৃত অর্থের স্থিতি ছিল ৬৫১ কোটি টাকা। গত মার্চে গ্রাহক ছিল ৭ লাখ ১২ হাজার এবং জমাকৃত অর্থের স্থিতি ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে হিসাব বেড়েছে প্রায় ৯০ হাজার এবং স্থিতি বেড়েছে ১৭০ কোটি টাকা। গত জুনে ৯২ জন এজেন্ট বেড়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৪৭টিতে এবং আউটলেট ২০১টি বেড়ে হয় ৩ হাজার ২২৪টি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার গ্রাহকদের হিসাবে মোট জমা হওয়া অর্থের মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের গ্রাহকদের স্থিতি সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া আউটলেটও বেশি ডাচ্-বাংলার। সবদিক বিবেচনায় এ ব্যাংকটি বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে এগিয়ে রয়েছে। এর পরের অবস্থানে আছে ব্যাংক এশিয়া। তৃতীয় অবস্থানে আছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। এ ছাড়া সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও মিডল্যান্ড ব্যাংক বেশ আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে। গত মাস থেকে কাজ শুরু করেছে সিটি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। এ ছাড়া এবি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড শিগগিরই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কাজ শুরু করবে। এই ব্যাংকগুলোসহ এখন পর্যন্ত মোট ১৭টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এজেন্ট ব্যাংকিং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক হাজার ৩১৪টি আউটলেটের মাধ্যমে ৮৯০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স গ্রহণ করেছেন গ্রাহকরা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেটের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিতরণে এগিয়ে আছে ব্যাংক এশিয়া। সম্প্রতি এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিতরণের জন্য ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সঙ্গে একযোগে কাজ শুরু করেছে ব্যাংকটি। এ বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, ‘ব্যাংক এশিয়ার রয়েছে আধুনিক ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রযুক্তি ও দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের রয়েছে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে নিরাপদে রেমিট্যান্স পৌঁছে দেওয়ার বিস্তর অভিজ্ঞতা। আমাদের উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তির ফলে এখন দেশের যেকোনো প্রান্তে বসবাসকারী ব্যক্তি বিদেশ থেকে তার নামে পাঠানো টাকা কাছাকাছি যেকোনো ব্যাংক এশিয়া এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট থেকে সংগ্রহ করতে পারছেন।’
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের এসব আউটলেটের মধ্যে অনেকে যুক্ত হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) সঙ্গে। ইউডিসির সঙ্গে যুক্ত হওয়া আউটলেটের সংখ্যা এখন এক হাজার ৩১৪টি। যার মধ্যে ব্যাংক এশিয়ার এক হাজার ২২টি, মধুমতি ব্যাংকের ১০০টি এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১৯২টি আউটলেট রয়েছে।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শুরুটা ব্যাংক এশিয়ার হাত ধরে হলেও বর্তমানে এই ব্যাংকিংয়ে ভালো করছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং করার ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতাকে আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যেসব ভুল ছিল সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এজেন্ট ব্যাংকিং করছি। আমাদের প্রায় দেড় হাজার আউটলেট আছে। এর মধ্যে ১০০ আউটলেট লাভজনক। বাকি আউটলেটগুলো লাভজনক পর্যায়ে আনাই আমাদের এখনকার লক্ষ্য।
জানা গেছে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসতে ২০১০ সালে চালু হয় মোবাইল ব্যাংকিং। এই সেবার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার সূত্রপাত ঘটায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারির পর ২০১৪ সালে প্রথম এ সেবা চালু করে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়া।
নীতিমালায় প্রথমে শুধু পল্লী এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং করার সুযোগ দেওয়া হলেও পরের বছর নীতিমালা কিছুটা সংশোধন করে পৌর ও শহর অঞ্চলেও এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর সুযোগ দেওয়া হয়। তবে মেট্রোপলিটন ও সিটি করপোরেশন এলাকায় না করার যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা আগের মতোই বহাল রাখা হয়।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একবারে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জমা অথবা তোলা যায়। তবে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে উত্তোলন সীমা প্রযোজ্য হয় না। দিনে দুবার জমা ও উত্তোলন করা যায়। প্রতি এজেন্টকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাব থাকতে হয়।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, টাকা স্থানান্তর (দেশের ভেতর), রেমিট্যান্স উত্তোলন, বিভিন্ন মেয়াদি আমানত প্রকল্প চালু, ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল পরিশোধ, বিভিন্ন প্রকার ঋণ উত্তোলন ও পরিশোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সরকারি সকল প্রকার ভর্তুকি গ্রহণ করা যায়। এজেন্টরা কোনো চেক বই বা ব্যাংক কার্ড ইস্যু করতে পারে না। এজেন্টরা বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত কোনো লেনদেনও করতে পারেন না। এ ছাড়া এজেন্টদের কাছ থেকে কোনো চেকও ভাঙানো যায় না। মোট লেনদেনের ওপর পাওয়া কমিশন থেকেই এজেন্টরা আয় করেন।