চলনবিল এখন মধুর ভান্ডার

চলনবিল এখন মাছ ছাড়াও ধান, সরিষা, রসুনের পাশাপাশি মধু উৎপাদনেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে বিল। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠে এখন সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠ জুড়ে হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মধু উৎপাদনে চলনবিলে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলতি মৌসুমে চলনবিল অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় হাজার টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মৌ-চাষিরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলের চাটমোহর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহংজাদপুর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে প্রায় ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবী জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। চলনবিলের মাঝ বরাবর বনপাড়া-হাটিকুমরুল যমুনা সেতু সংযোগ মহাসড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। নয়নাভিরাম সেই সরিষা ক্ষেতের আলে আলে এখন শুধুই সারিসারি মৌ-বাক্স।
ইউরোপিয়ান হাইব্রিড এপিস মেলিফেরা মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌ-বাক্সে। চলতি মৌসুমে যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে তাহলে চলনবিল থেকে এক হাজার ৫শ’ থেকে এক হাজার ৬শ’ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি ১৫০ টাকা হিসেবে ২২ থেকে ২৫ কোটি টাকা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৭ শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরষে ক্ষেতের আলে ৪৫ থেকে ৫৫ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরষে ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।
উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সভাপতি পাবনার চাটমোহরের জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুণ মৌবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌচাষিরা। পরিবেশবিদরা জানান, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।
বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কেজি। প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় অগ্রিম বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও প্রসাধনী কোম্পানির এজেন্টরা চলনবিলের মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. তাহমিনা হক জানান, অতীত কাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানি, হূদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। এছাড়াও মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে।
চলনবিলের ‘পরিবর্তন’ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাড়াশ উপজেলার প্রশিক্ষিত ২৫ জন আদিবাসী নারী মধু সংগ্রহ করছেন। চাটমোহর উপজেলাতেও ২৫ জন মৌচাষি এখন মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিসিকের মাধ্যমে মৌ-চাষে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তারা মৌ-চাষ শুরু করেছেন।