নিটল নিলয় গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমাআহমাদ। পাশাপাশি জনতা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও কর্মরতআছেন। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের অধীনেএন্টারপ্রেনারশিপ নিয়ে একটি কোর্সের ক্লাস নেন তিনি। এছাড়াবেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নেন তিনি। অর্থের দিকথেকে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করেন সফল এনারী…
ছোট বয়সে দেখা স্বপ্ন পরিবর্তন হয় ক্ষণে ক্ষণে। কখনো সেই স্বপ্নের বিস্তৃতি ঘটে, কখনো বদলে যায় পুরোটাই। কার ক্ষেত্রে এটা কতটা সত্য, সে হিসাব না কষলেও বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সেলিমা আহমাদের ক্ষেত্রে সেটাই সত্যি হয়েছে। কেননা সফল এই নারী ছোটবেলায় নিজেকে কখনো সাংবাদিক হিসেবে কখনোবা বাবার মতোই ব্যাংকার হিসেবে ভাবতেই ভালোবাসতেন। কিন্তু নিয়তিতে ব্যবসায়ী শব্দটাই হয়তো স্পষ্ট ছিল। তাই তো আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী। নিটল নিলয় গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেসঙ্গে জনতা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও কর্মরত আছেন। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সেলিমা আহমাদ শুধু দেশেই নয় পরিচিতি গড়ে তুলেছেন বিশ্বদরবারেও। আজকের আয়োজনে থাকছে সফল এই নারীর চড়াই-উতরাই পথের গল্প—
সেলিমা আহমাদের বাবা ছিলেন সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। তাই তার বেড়ে ওঠা ঢাকায় হলেও বাবার চাকরির বদলির জন্য নবম শ্রেণীতে উঠে চলে যেতে হয় খুলনায়। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আবার ঢাকায় চলে আসেন। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ভালো ফলাফলের সঙ্গে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। সবকিছু ঠিক মতোই চলছিল। উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ দিকে হুট করেই বেশ ভালো ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে হয়ে যায় তার। সে সময় তো ধরেই নেয়া হতো বিয়ে মানেই জীবনের একটা অধ্যায়ের ইতি টানা। অর্থাৎ সেখানেই ইস্তফা দিতে হতো পড়াশোনাকে। কিন্তু সেলিমা আহমাদের ক্ষেত্রে বিপরীতটাই ঘটে। কেননা অল্প বয়সে বিয়ে হলেও বিয়ের পর পড়াশোনা ঠিকই চালিয়ে গিয়েছেন স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির সহায়তায়। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করেন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে।
সেলিমা আহমাদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পের শুরুটা ১৯৮২ সালে। তখন সবে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বন্ধু মিলে খুলে ফেললেন একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠানের কাজই ছিল উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা। তবে সেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে বেশি দূর এগোতে না পারলেও বছর দুই পর স্বামীর সহযোগিতায় শুরু করেন গাড়ি আমদানির ব্যবসা। এভাবেই ১৯৮৪ সালে যাত্রা করে নিটল মোটরস নামে তার প্রতিষ্ঠান।
সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে সেলিমা আহমাদ জানান, ‘তখন ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ এতটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। বাস-ট্রাক আমদানি করে বিক্রি করার বিষয়টি অনেকেই ভালোভাবে দেখত না। এমনও হয়েছে শুরুর দিকে নিটল মোটরসের ছোট্ট অফিসটিতে মানুষ এসে যখন আমায় দেখত, তখন গাড়ি না কিনেই ফিরে যেত। কেননা তখন তাদের ধারণাই ছিল মেয়েমানুষ গাড়ি সম্পর্কে খুবই কম বোঝে। অথচ সে সময় আমি প্রচুর পড়াশোনা করতাম গাড়ি-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আত্মস্থ করার জন্য।’
শুধু তাই নয় অনেকে তো চোখ কপালে তুলে বলেও বসত ভদ্রঘরের মেয়ে কি এমন বাস-ট্রাক বিক্রির ব্যবসা করে? কিন্তু এসব কথার কোনোটাই গায়ে মাখেননি আজকের সফল এই নারী। বরং সবসময় তিনি ভেবেছেন যা-ই করেন না কেন সেটা যদি মন দিয়ে করা যায়, তাহলে তাতেই সফলতা আসবে। নিজের কাজের বিষয়ে প্রত্যয়ী ছিলেন বলেই হয়তো একটা সময় এসে নিটল নিলয় গ্রুপ মানুষের মনে আস্থা তৈরি করে নিয়েছে। বর্তমানে সেলিমা আহমাদ নিটল নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
পরবর্তীতে ব্যবসা প্রসার লাভ করা শুরু করলে তিনি নিজ প্রচেষ্টায় শুরু করেন সিল্কের তৈরি কৃত্রিম ফুল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে কারখানা গড়ে তোলেন। তার পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় অনেক নারীর।
১৯৯৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক পদে নির্বাচিত হন। বলে রাখা ভালো, সে সময় তিনিই একমাত্র নারী পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। তখন দেশের ২৪ জন নারী উদ্যোক্তা নিয়ে গঠন করেন উইমেন চেম্বার। সে সময় নানা বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। শেষতক সরকার ২০০১ সালের ২০ জুন উইমেন চেম্বার করার অনুমোদন দেয়। যদিও টানা নয় বছর এফবিসিসিআই এর নিবন্ধন দেয়নি। এমনকি বারবার বন্ধ করার পদক্ষেপও নেয়। বর্তমানে ব্যবসায়ী নারীদের এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন সেলিমা আহমাদ।
ব্যবসার সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালে ব্যবসায়ীদের নোবেলখ্যাত সম্মানজনক পুরস্কার অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড উঠে আসে তার অর্জনের ঝুলিতে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী এ সফল উদ্যোক্তা চান প্রত্যেক নারী তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বাবলম্বী হোক। আর তাই তিনি নারী উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নতুন উদ্যোক্তারা যাতে ব্যাংক লোন পেতে কোনো ঝামেলার সম্মুখীন না হন, সেসব বিষয়ের ওপর কাজ করে যাচ্ছেন। কাজ করছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়েও। তিনি বলেন, যেকোনো নারীই সফল হতে পারে যদি তার পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র তাকে সাহায্য করে।
সেলিমা আহমাদের প্রাপ্তির খাতাটা বেশ ভারী। তবে তার কাছে এখন পর্যন্ত বড় প্রাপ্তি হচ্ছে অর্থের দিক থেকে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য কাজ করতে পারা। নারীদের নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। ভালোবাসার আরো একটি কাজের কথা উঠে আসে তার মুখে। ছাত্র পড়াতে বেশ ভালোবাসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের অধীনে এন্টারপ্রেনারশিপ নিয়ে একটি কোর্সের ক্লাস নেন তিনি। এছাড়া বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নেন সেলিমা আহমাদ। তার মতে, তিনি যদি ব্যবসায়ী না হতেন, তাহলে অবশ্যই শিক্ষকতা করে জীবন পার করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বেশ গোছানো স্বভাবের নারী তিনি। কর্মজীবী নারী বলে কখনো পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেননি। এখনো নিজেই বাজার করতে ভালোবাসেন। অতিথি এলে খাওয়াতে ভালোবাসেন নিজ হাতে রান্না করে। যত্নশীল তিনি নিজের প্রতিও। নিয়ম মেনে খাওয়া এবং অন্যান্য কাজ সারেন। এই বয়সেও নিয়মিত দৌড়াতে যান, সাঁতার কাটেন। ভালোবাসেন নিজেকে পরিপাটি রাখতে। তার ভাষ্যমতে, শত ব্যস্ততা থাকলেও নিজের ওপর এর প্রভাব পড়তে দেয়া যাবে না। মাকে দেখেছি শত কাজের মধ্যেও খুব পরিপাটি থাকতেন। সেটাই রপ্ত করেছি।