নতুন উচ্চতায় তামান্না-নাইমা
ঢাকা সেনানিবাসের ঘাঁটি বাশার। গতকাল সোমবার অগ্রহায়ণের শুভ্র সকালে এমআই-১৭ হেলিকপ্টার উড্ডয়নে উঠছেন দুই নারী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও তামান্না-ই-লুৎফী। চোখে-মুখে তাদের আত্মবিশ্বাসের সুস্পষ্ট ছাপ। এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই এবার তারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাচ্ছেন কো-পাইলটের গুরুদায়িত্ব নিয়ে। সেই সুবাদে এবারই প্রথম শান্তি মিশনে বাংলাদেশ থেকে বৈমানিকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে চলেছেন এ দেশের দুই নারী, যা এ দেশের সামরিক ইতিহাসেও নতুন এক মাইলফলক। কঙ্গোর উদ্দেশে ৭ ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করবেন তারা। এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই এর আগে এ দেশের ইতিহাসে প্রথম সামরিক নারী বৈমানিক হওয়ার গৌরবও অর্জন করেন তারা দু’জন।
বিশ্বশান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মহৎ যাত্রা উপলক্ষে গতকাল সোমবার ঘাঁটি বাশারে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন এই দুই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। হেলিকপ্টার উড্ডয়নে যাওয়ার আগে রানওয়েতে তারা শোনালেন কীভাবে প্রথম সামরিক নারী বৈমানিক হয়ে উঠলেন। বললেন প্রতিকূল পথ পেরোনোর কথা। কথায় কথায় আগামী দিনের পরিকল্পনাও জানালেন তারা।
তামান্না-ই-লুৎফী সমকালকে জানালেন, তার বৈমানিক হওয়ার পেছনে রয়েছে বাবার অনুপ্রেরণা। নানা প্রতিকূলতা থাকলেও পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের সহযোগিতার কারণে তিনি এত দূর আসতে পেরেছেন। এ ছাড়া বিমানবাহিনী শুরু থেকেই তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছে। এখানকার প্রশিক্ষণই তাদের মূল শক্তি। বিদেশে গিয়েও নিজ বাহিনী ও দেশের সম্মান বাড়াতে সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন তিনি।
বৈমানিক তামান্নার জন্ম ১৯৯৩ সালে, যশোরে। তার বাবা লুৎফর রহমান বিমানবাহিনীর সাবেক গ্রুপ ক্যাপ্টেন। তিনি বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। পরে পড়াশোনা করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে।
নাইমা হক জানালেন, যোগ্যতা ও মেধাসম্পন্ন যে কেউ সামরিক বাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসতে পারেন। সেখানে মেধা বিকাশের সুযোগ রয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্বসূরিদের দেখানো পথে তাদের গৌরবজনক অধ্যায়কে আরও গৌরবান্বিত করতে তারা যথাসাধ্য ভূমিকা রাখবেন। তিনি বলেন, ১৪ বছর ধরে শান্তিরক্ষা মিশনে বিমানবাহিনী অংশ নিচ্ছে। তবে এবারই প্রথম শান্তিরক্ষা মিশনে দুই নারী বৈমানিক নিয়োগ পেয়েছে। এটা দেশের জন্য অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার।
১৯৯০ সালে নাইমা ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নাজমুল হক। হলি ক্রস গার্লস হাই স্কুল ও কলেজ থেকে নাইমা এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। পরে তিনি পড়াশোনা করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ২০০০ সালে প্রথম সামরিক বাহিনীতে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ শুরু করে। বিমানবাহিনীর বিভিন্ন নারী কর্মকর্তা মাতৃ সংস্থা ছাড়াও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন। সামরিক বৈমানিকের মতো চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নারী বৈমানিকদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর বিমানবাহিনীতে দুই নারী কর্মকর্তা নাইমা ও তামান্না মনোনীত হন উড্ডয়ন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট তারা গ্রাউন্ড প্রশিক্ষণ ও ২৩ সেপ্টেম্বর উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরে ২৫ ঘণ্টা সফল উড্ডয়ন শেষে তারা একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করায় তাদের বৈমানিক হওয়ার প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়।
নাইমা ও তামান্না বেল-২০৬ হেলিকপ্টারে ৬৫ ঘণ্টা উড্ডয়নের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করার পর বিমানবাহিনীর বিভিন্ন হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রনে দায়িত্ব পালন করেন। তারা ২০৬ হেলিকপ্টার কনভারশন কোর্স, এমআই-১৭, এমআই-১৭১, এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। তারা দু’জনই পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন্স উত্তরণে অপারেশনাল পাইলটের দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত জীবনে বৈমানিক হিসেবে তাদের সাফল্য বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উড্ডয়নের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। বিমানবাহিনীর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও নারীদের অগ্রযাত্রায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।