বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার কৃষিজীবন

গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ গ্রামবাংলার এমন দৃশ্য এখন শুধুই ইতিহাস। তবে পঞ্চগড় সদর উপজেলার দরবেশপাড়া গ্রামের কৃষক জব্বারুল হক সেসব অহংকারের দিন ফিরিয়ে এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেও চাকরি না করে পেশা হিসেবে কৃষিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। সফলও হয়েছেন। কৃষিকাজে অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদক। জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে কামাত কাজলদীঘি ইউনিয়নের দরবেশপাড়া গ্রাম। সবুজ বৃক্ষলতা, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, বিস্তীর্ণ ধানখেত আর নানা মৌসুমি ফসলের ঘ্রাণের একটি গ্রাম। এ গ্রামেই নিজস্ব কৃষি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন কৃষক জব্বারুল হক। প্রায় পাঁচ একর জমির ওপর গড়ে তুলেছেন তার বাড়ি। কী নেই এ বাড়িতে? ফল, ফুল ও ঔষধি গাছপালা থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল সব আছে তার। আছে পুকুরভরা মাছ। গোয়ালভরা গরু। নানা ধরনের অর্থকরী ফসল ছাড়াও তিনি উৎপাদন করছেন বিষমুক্ত শাকসবজি। পুরো বাড়িই ঘিরে রয়েছে বিশাল বাগান। বাগানের ভিতরে চাষ করছেন মৌমাছি। আম, লিচু কলা, কমলা, চালতা, নারিকেল, আমড়াসহ অর্ধশতাধিক ফলের গাছ রয়েছে এ বাগানে। রয়েছে নানা ঔষধি গাছ।
কৃষক জব্বারুলের বাড়িতে গোলাপ, জবা, এলামুন্ডা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, সর্পগন্ধা, মেহেদীসহ নানা ধরনের ফুল ফুটে থাকে সারা বছর। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে সাড়া বাড়ি। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বাবা তবিবর রহমানের ব্যবসায় যোগ দেন জব্বারুল। কিন্তু তার ছোটবেলা কেটেছে কৃষক নানার বাড়িতে।

তিনি ব্যবসায় মন বসাতে পারছিলেন না। তাই কয়েক বিঘা জমিতে শুরু করেন চাষাবাদ। এরপর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিছু দিনের জন্য স্কুলশিক্ষকের চাকরি নেন। কৃষিকাজের সাফল্য ধরা দেওয়া শুরু করে। হাতের মুঠোয় যেন আলাদিনের প্রদীপ। এরপর শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোপুরি মনোযোগ দেন কৃষিকাজে। কঠোর পরিশ্রম আর মেধা প্রয়োগ করে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি কৃষিকাজের লাভের টাকা দিয়ে আরও ৪০ বিঘা জমি কেনেন। পুকুর ঘেরা বাগানের ভিতর একটা বাড়িও করেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলেন। জব্বারুল হকের সহধর্মিণী আয়েশা আক্তার বলেন, আমরা একমাত্র কৃষি করেই স্বাবলম্বী হয়েছি। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। বাইরে থেকে বেশি কিছু কিনতে হয় না আমাদের। সববিছু নিজেরাই উৎপাদন করি। মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করি। আবৃত্তি আমার খুব পছন্দ। নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় কাটাই। এসব নিয়ে ভালোই আছি। সরেজমিন দেখা যায়, সব ধরনের ফসলের আবাদ করেন কৃষক জব্বারুল। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, টমেটো, মরিচ, বাদাম, ইক্ষু, বেগুনসহ সারা বছর আবাদ করেন তিনি। একই জমিতে একই সময়ে সাথি ফসলও আবাদ করেন। আর এসব আবাদ করে খরচ বাদে তিনি প্রতি বছর আয় করছেন ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা। পরিবারের সদস্যরা খেতে পারছেন নিজেদের উৎপাদিত মাছ, মুরগি, মধু, গাইয়ের দুধ আর শাকসবজি। তার এ সাফল্য দেখে বর্তমানে আশপাশ এলাকার অনেক কৃষকই নতুন করে কোমর বেঁধে কৃষিকাজে নেমে পড়েছেন। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দশনার্থীরাও আসছেন তার কৃষি খামার দেখতে। কৃষক জব্বারুল হক বলেন, এ পেশায় একটু পরিশ্রম করলে সুন্দর জীবনযাপন করা যায়। শিক্ষিত হয়ে চাকরিই করতে হবে এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে যে কেউ এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুন্দর সময় কাটাতে পারে। দুগ্ধ খামার আর কৃষিকাজে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৪ সালে তাকে রাষ্ট্রপতি পদকে (ব্রোঞ্জ) ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরির আশায় ছুটছেন যেসব বেকার যুবক জব্বারুল আজ তাদের কাছে প্রেরণা হয়ে উঠেছেন। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মতিউর রহমান জানান, জব্বারুল একজন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক কৃষক। কৃষিতে নানা সাফল্য দেখে কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে এবার তাকে আমের প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। সহযোগিতা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।