বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে ৭ মার্চের ভাষণ গর্বিত : নেপথ্যজন রোকেয়া

দেরিতে হলেও ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ছয় বছর আগে রোকেয়া খাতুন প্রথম ইউনেস্কোয় তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এর মাধ্যমে নিজেকে ইতিহাসের ‘ক্ষুদ্র’ অংশীদার করতে পেরে বেশ আনন্দিত তিনি।

 

কিভাবে একটি জাতি একজন মানুষের ভাষণ শুনে একটি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে, সে বিষয়টিই ইউনেস্কোয় তুলে ধরেছিলেন রোকেয়া। রোকেয়া খাতুন আনন্দের সঙ্গে বলেন, ‘জাতির পিতার সেই ভাষণ শুনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে এই দেশ উপহার দিয়েছেন, আর তার সেই মহান ভাষণ পেয়েছে ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ স্বীকৃতি। এর সামান্য অংশীদার হয়ে মনে হচ্ছে, জাতির পিতার জন্য সামান্য কিছু করেছি।’

 

২০০৩ সালে ২২তম বিসিএসএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন রোকেয়া খাতুন। স্বামী ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান। স্বামীর কর্মসূত্রে ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের প্রভাষক। স্বামীর বদলি হওয়ায় চলে আসেন ঢাকায়। প্রথমে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এবং পরে ২০০৭ সালে প্রেষণে বদলি হয়ে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোয়। সুযোগ হয়েছিল ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপে অন দ্য ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার। দায়িত্ব দেওয়া হয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যগত গুরুত্ব আছে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে বাংলাদেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ নথি বা প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপনের। এ বিষয়ে রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘প্রথম দিকে স্থানীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন হিসেবে ‘চর্যাপদ’ তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিষয়টির পরিবর্তে আমি ‘বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ নিয়ে উপস্থাপন করার কথা চিন্তা করি। এক্ষেত্রে আমার স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা শাহ মিজান শাফিউর রহমান আমাকে অসাধারণ অনুপ্রেরণা জুুগিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন, যে ভাষণ পুরো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল, ইউনেস্কোর তালিকায় জায়গা পেতেও সে ভাষণের রয়েছে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব।’

 

এরপর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর তত্কালীন সচিব আব্দুল খালেকের সঙ্গে আলোচনা করলে উত্সাহ পান রোকেয়া। বিষয়টি নিয়ে শুরু করেন গবেষণা। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেয়ে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং ওয়ার্কশপ অন দ্য ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’।

 

২০১১ সালের ১১ থেকে ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত ওই কর্মশালায় বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নেয় মিয়ানমার, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, পালাও, সলেমন দ্বীপপুঞ্জ, লাওস, ফিজি, পাপুয়ানিউগিনি, পূর্ব তিমুরসহ ১১টি দেশের প্রতিনিধিরা। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কার মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ)-এর তত্কালীন চেয়ারপারসন রোজলেন রাসেল, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়ারপারসন রে অ্যাডমন্ডসনসহ পাঁচজন বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের ভাষণের ওপর আমার উপস্থাপনা প্রশংসা পায়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তালিকায় ৪৮ নম্বর স্থানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই সংবাদ পেয়ে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছেন রোকেয়া। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর হলেও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের বিশ্বস্বীকৃতি বাংলাদেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিলো। আমি সেই প্রয়াসের ছোট একটি অংশ হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। এই আনন্দ ঘোষণা যখন প্রথম শুনলাম, তখনই হয়েছি আনন্দে আত্মহারা।’