লাল-হলুদের বাহারি কলাবতী ম্যাজিক

অন্যান্য জাতের ফুল ও ফলের গাছও আছে সেখানে। প্রথম দেখায় মনে হবে এটি কোনো বিশ্রামকেন্দ্র বা বাগানবাড়ি। আসলে এটি একটি মানববর্জ্য শোধনাগার। নয়ন জুড়ানো কলাবতী সেখানে কেবলই শোভাবর্ধনের জন্য নয়; এটি সেখানে এক ম্যাজিক।
এমন একটি পরিবেশে দেশের প্রথম মানববর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করেছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ১ দশমিক ৩ একর জমির ওপর স্থাপিত এই শোধনাগারটি পৃথিবীর বৃহত্তম মানববর্জ্য শোধনাগার। বাসাবাড়ি, অফিস আদালত, শপিং মল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনার সেপটিক ট্যাংক থেকে বিশেষ উপায়ে বর্জ্য সংগ্রহ করে সরাসরি এই শোধনাগারে ফেলা হচ্ছে।

এখানে ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি। যার অন্যতম প্রাণ ভোমরা ওই বাহারি কলাবতী।

কোনোরূপ দুর্গন্ধ ছাড়াই এখানে নগরীর হাজার হাজার টন বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নদীতে বা খালে আর মানববর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
সরেজমিন ঘুরে ও সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন থেকে শহরতলীর রাজবাধ এলাকাটি সিটি করপোরেশনের ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ময়লা ফেলার কারণে সেখানে ছিল পুতিগন্ধময় পরিবেশ, যা এলাকাবাসীর দুর্ভোগেরও অন্যতম কারণ। এ অবস্থায় স্থানীয়দের দুর্ভোগ লাঘবে আধুনিক মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। তারই অংশ হিসেবে রাজবাধে ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের’ অর্থায়নে এক কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে মানববর্জ্য শোধনাগারটি গড়ে তোলা হয়েছে। নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসএনভি) তত্ত্বাবধানে নির্মিত মানববর্জ্য শোধনাগারটির কাজে সহযোগিতা করেছে থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সংস্থাগুলো প্রাথমিকভাবে তিন বছর আগে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আধুনিক করতে শুরু করে। তবে মূল কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। আর গত ৪ মার্চ শোধনাগারটি চালু হয়।

কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আব্দুল আজিজ ও কঞ্জারভেন্সি অফিসার মো. আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানববর্জ্য শোধনাগার। যেখানে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার লিটার মানববর্জ্য পরিশোধনের সুযোগ রয়েছে। চালুর পর থেকে গেল আট মাসে এখানে তিন লাখ ১৬ হাজার লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা হয়েছে। মূলত বিভিন্ন বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনার সেপটিক ট্যাংক থেকে ‘ভ্যাকুটাগের’ মাধ্যমে মানববর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ভ্যাকুটাগ হলো ট্যাংকযুক্ত এক ধরনের গাড়ি। মেশিনের সাহায্যে পাইপ দিয়ে এটি সেপটিক ট্যাংক থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে নিজের ট্যাংকে নিয়ে নেয়। এভাবে মল সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাধ শোধনাগারে। সেখানে পাইপের মাধ্যমে ভাগ হয়ে সব মল কয়েকটি বেডে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি বেড প্রতিদিন ৩৬ হাজার লিটার বর্জ্য ধারণ করতে পারে। বেডগুলোর নিচে ইটের খোয়া, পাথর ও বালু দিয়ে ফিল্টার পদ্ধতিতে বর্জ্য পানি পরিশোধন করা হয়। বর্জ্য শোধনের জন্য এর পাশে উঁচু জায়গায় কলাবতী ফুলের চাষ করা হয়েছে। এই ফুলের গাছ মানববর্জ্যের ব্যাকটেরিয়া শোষণ করে থাকে।

কেসিসি কর্মকর্তারা বলেন, মূলত কলাবতী গাছই এ প্রকল্পের ম্যাজিক। মানববর্জ্য পরিশোধনে এ গাছের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। এর মূল যত প্রোথিত হবে, তত বেশি কাজ হবে।

তাঁরা আরো জানান, মানববর্জ্য শোধনাগারে খুলনা সিটি করপোরেশন এখন মানববর্জ্য ব্যবহার করে জৈব সার, বায়োগ্যাস এবং সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে মানববর্জ্য শোধনাগারের পার্শ্ববর্তী স্থানে রাজবাধের ট্রেন্সিং গ্রাউন্ডে (ভাগাড়) বর্জ্য দ্বারা কম্পোস্ট সার উৎপাদন করা হচ্ছে। খুলনা সিটি করপোরেশনের সহযোগতািয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রাজটিক কয়েক বছর যাবৎ কম্পোস্ট উৎপাদন করছে, যা খুলনা অঞ্চলের জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

খুলনা সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন মানববর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গতিশীল করা হয়েছে। এ জন্য নগরবাসীকে আরো সচেতন হতে হবে। তারা যেন ভ্যাকুটাগের মাধ্যমে বছরে একবার সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করান। এতে পরিবেশ দূষণ যেমন কমবে, তেমনি চিকিৎসা খরচও বেঁচে যাবে। ’