ক্র্যাক প্লাটুনের গাড়ি বানানোর স্বপ্নপূরণ

২০১৫ সাল, ২য় বর্ষ চলছে। বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছা নিয়ে রুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে মুসা। কিন্তু আসলেই কি পড়ছে সে! কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা বোধ হতো তার। স্বপ্ন ছিল গাড়ি বানানোর। কিন্তু কেউ নাকি বানায় না ৪র্থ বর্ষ শেষ করে চাকরি পাওয়ার আগে! কিন্তু এ কথা মেনে নিতে পারল না মুসা। অন্তরের সেই তীব্র ইচ্ছা পূরণে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে একই মানসিকতার ৭ জনকে পেয়ে গেল। অটোমোবাইল কার বানানোর একটি কম্পিটিশনের রেজিস্ট্রেশন করে ফেলল। সিলিকন ভ্যালির মতো প্রস্তুত হল ক্র্যাক প্লাটুন টিম! দেখতে দেখতে দেশে ও ভারতে দুটি কম্পিটিশন জিতে গেল টিম ক্র্যাক প্লাটুন! কিন্তু বিশ্বের সামনে নিজেদের বানানো গাড়ি তুলে ধরার সেই দুরন্ত স্বপ্নটা তো বাকিই রইল। ২০১৭ সাল, এবার স্বপ্নটি আরও বড়। টিমের সদস্য তখন ৮ থেকে বেড়ে ২৪ জন। বিশ্বের সামনে হাজির হবে তাদের স্বপ্ন। কিন্তু এতই কি সহজ বিশ্বের সামনে হাজির হওয়া!

 

জাপানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অটোমোবাইলস কার বানানোর কম্পিটিশন ছিল এবার। লক্ষ্যস্থির হলো, অংশগ্রহণ করবে ক্র্যাক প্লাটুন। শুরুতেই রেজিস্ট্রেশন। লাগবে ২ লক্ষ টাকা! রেজিস্ট্রেশনের দিন দুপুরে ম্যানেজ হলো টাকা। শুরু হলো গাড়ি বানানো, পার্টস কেনা, জাপান ভ্রমণ, গাড়ি শিপিং করা প্রভৃতি। এবার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল ক্র্যাক প্লাটুনের। সমস্ত কাজটার জন্য ৮০ লক্ষ টাকার বাজেট হলো। স্বপ্নটা কেমন যেন অবাস্তবতার দিকে মোড় নিচ্ছিল। ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানির কাছে প্রেজেন্টেশন নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। কিন্তু এত বড় বাজেট শুনে সবারই একটা কথা, ‘নাহ, তোমরা বোধহয় পারবে না।’

 

আর এর সঙ্গে শুরু হলো, গাড়ির পার্টস নিজেরা বানানোর চেষ্টা। প্রতিদিন ক্লাস শেষে রুমে না গিয়ে ডিরেক্ট ল্যাবে গিয়ে কাজ করা শুরু করল তারা। যেহেতু হাতে টাকা নেই, কমানো লাগবে বাজেট। তাই প্রতিদিন পুরোনো গাড়ির পার্টস নিয়ে কাজ করতে থাকল তারা। সেগুলোকে প্রতিদিন ঘষামাজা করত, শান দিত। এদিকে দেশে নিজেদের জোরে ইয়ুথ ফেস্ট নামে একটি কম্পিটিশন জিতে আরও কিছু টাকা ম্যানেজ হলো। অবশেষে তাদের প্রবল ইচ্ছে দেখে আরও কিছু কোম্পানি এগিয়ে এলো। শেষমেশ ম্যানেজ হলো সবকিছু। যাত্রা শুরুর দিনটিতেও তারা ২ ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম নিতে পারল না! অবশেষে সেই দিন চলে এলো। জাপানে একত্রিত হলো বিশ্বের ২৬টি দেশ থেকে আসা ১১৪টি টিম। প্রথমদিন ছিল বানানো গাড়িটির নতুনত্ব ও আইডিয়া প্রেজেন্টেশন পর্ব। খুব ভালো সাড়া পেল ক্র্যাক প্লাটুন। তারপরের দিন ছিল গাড়ি প্রেজেন্টেশনের দিন। ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুত হয়ে গেল টিম! আজ তাদের দীর্ঘ ৪ মাসের কষ্টের বানানো গাড়ির প্রেজেন্টেশন। অপেক্ষা করছে টিম ক্র্যাক প্লাটুন। তাদের গাড়ি বর্ডারের একদম শেষ মাথায় চলে এলো। হঠাত্ খবর এলো। বর্ডারে কিছু গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে। তাদের ও ইন্ডিয়া টিমের গাড়ির আজকে আসা সম্ভব না!

 

ততক্ষণে সময় চলে এসেছে বাংলাদেশের গাড়ি প্রদর্শনের। হঠাত্ যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল ২৪ জনের রক্তের ভিতর। মনে পড়ে গেল বিগত চারমাসের কথা। কারো চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে গেল। কেউ হয়তোবা দেখল না। কারণ সেই মুহূর্তে ভাগ্যকেও অশ্রু দেখাতে মন চায় না, এত ক্ষোভ ভিড় করে মনে!এরপর বীর বিজয়ী রূপে দেশে ফিরল টিম ক্র্যাক প্লাটুন! তারা পরের রাউন্ডে অংশগ্রহণ করতে না পেরেও শুধু আইডিয়ার জোরে ৮৪তম হয়েছে ১১৪টি দলের মধ্যে। তারা কি হেরে গেছে ভাগ্যের কাছে?

 

না। কারণ, স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে আসলে ঠিক কত মাইল দৌড়াতে হবে তা কি আমরা জানি? তাই বিজয়ী খেলার মাঠে তৈরি হয় না, বিজয়ী তৈরি হয় অনুশীলনের মাঠে। যেখানে আমরা জ্ঞান অর্জন করি, সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নানা রহস্য উন্মোচন করি এবং জ্ঞানকে আয়ত্ত করে প্রকৃত অর্থে কাজে লাগাই।