এদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে গত সাড়ে আট বছরে বেশকিছু যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে, যা ভিশন ২০২১-এর বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮৭%-এর অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে; ১৩%-এর কম কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে। অবশ্য সরকার দেশের উন্নয়ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই গ্রামীণ এলাকায় যথাযথ উন্নয়নের নির্দেশনা দিচ্ছেন। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গ্রামীণ এলাকায় পণ্য বিপণন ব্যবস্থায় অনেক বেশি অগ্রযাত্রা সাধিত হচ্ছে। দেশের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের যে উদ্যোগ রয়েছে তাতে বেসরকারি খাত এবং উদ্যোক্তারা যদি অংশগ্রহণ করত পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় গ্রামীণ এলাকায় অনেক বেশি সাফল্য আনত বলে মনে করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ব্যাংকিং সেবার মান, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্তের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও অনেক নিচে নেমে গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত কৃষিজীবী এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করার জন্যে। সময়ের বিবর্তনে তাদের গৃহীত প্রকল্পসমূহ আরো যুগোপযোগী করা বাঞ্ছনীয় ছিল। আসলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করা তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ট্রেড ফাইন্যান্সিং এর বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যদি সবধরনের ব্যাংকিং কৃষি ব্যাংকই করবে তবে তা স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য অর্থাত্ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালীকরণ কৃষি ও কৃষিজ ঋণ বিতরণ, আধুনিক সেচপদ্ধতি ও জ্বালানি প্রবর্তন এবং নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিকরণ ব্যাহত হতে পারে। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে ব্যাংকের উচিত উন্নত কারিগরি কলাকৌশল গ্রহণ এবং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পল্লী শাখাগুলোকে ঢেলে সাজানো। বাহ্যিক শাখার সৌন্দর্যের চেয়ে জনকল্যাণমুখী আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ ব্যবস্থা গ্রামীণ অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপ দিতে সহায়তা করবে।
ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে বর্তমানে কমিউনিটি ব্যাংকিং সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা দরকার। অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, দেশে যেখানে তিরানব্বই হাজার গ্রাম রয়েছে যেখানে আট থেকে দশ হাজার শাখার মাধ্যমে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। দেখা যায় অঞ্চলভিত্তিক ব্যাংকের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং-এর খরচ বেশি হওয়ায় এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিটি ব্যাংকিং-এ ক্রমশ গ্রাহক বাড়ছে। হিসাব করলে দেখা যায় মোবাইল ব্যাংকিং এর চার্জ প্রতি হাজারে আমাদের দেশে অফিসিয়াল সাড়ে আঠারো টাকা হলেও সেখানে রাখে বিশ টাকা কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশে দশ হাজার টাকায় নেওয়া হচ্ছে মাত্র সাড়ে তিন টাকা। গবেষণায় দেখা যায়, মোবাইল ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে ১৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক অনুমতি পেলেও মাত্র একটি ব্যাংক সিংহভাগ ব্যবসা করছে। প্রয়োজন ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়্যাল স্টেইটমেন্টে মোবাইল ব্যাংকিং এর হিসাব-নিকাশ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ফলে গ্রামীণ এলাকায় এবং বিদেশ থেকে প্রবাসীরা অনেক ক্ষেত্রে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গ্রামীণ এলাকায় গ্রাহকের কাছে টাকা যাওয়ার আগে তিন/চারবার হাত বদল হয়। সে টাকা সরাসরি গ্রামীণ এলাকায় বিনিয়োগ হলে গ্রামীণ এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। এতে কর দেওয়ার লোকের সংখ্যাও বাড়ত। কমিউনিটি ব্যাংকিং আলাদা রেগুলেটারের আওতায় চালু করত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক এবং ডাকঘরকে সঞ্চয় বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনয়ন করা দরকার। এ ব্যাপারে একটি পর্যবেক্ষণের জন্য খুলনা জেলার দুটো প্রত্যন্ত গ্রামে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণের ফলে সাধারণ মানুষ দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষ উপকৃত হয়। বর্তমানের প্রচলিত ব্যবস্থায় মাইক্রো ফিন্যান্সিং এর ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে মূল ঋণ গ্রহণ করা হয়। অথচ কমিউনিটি ব্যাংকিং এর প্রচলন করা গেলে স্বল্প খরচে স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্পসমূহ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যাবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য বাস্তবমুখী ডিজিটালাইজেশানের মাধ্যমে দেশ, জাতি ও প্রগতির উন্নয়নে গ্রামীণ এলাকায় শরীক হচ্ছে—এটিকে আরো বেগবান ও শক্তিশালী করা দরকার। এজন্য এলাকা ভিত্তিক উন্নয়নে শরিক হওয়ার প্রয়োজনের নিরিখে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের আরো সক্রিয় হতে হবে, যাতে করে টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন হয়। গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের জন্যে স্থানীয় প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিধিতে পরিবর্তন এনে একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদকে চেয়ারম্যান করা ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে বর্তমানে প্রচলিত মান্ধাতার আমলের মডেল সময়োপযোগী করা দরকার। যেখানে কনভেনশনাল ব্যাংকের পক্ষে উন্নয়ন সম্ভব হয় না সেখানে নন-ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেহেতু বর্তমানে মূলত মুদ্রাব্যবস্থাপনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে অথচ আরো যে সমস্ত কর্ম রয়েছে, যেমন—আধুনিক ব্যাংকিং পদ্ধতি টেকসই উন্নয়নে অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আর অর্থ ব্যবস্থায় ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ—এসব কাজ প্রায় থেমে গেছে। এ অবস্থায় অলটারনেটিভ ব্যাংকিং-এর ব্যবস্থা করা জরুরি। মাইক্রোফিন্যান্সিয়্যাল ইন্সটিটিউটগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরির প্রয়াস নিচ্ছে। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ যেখানে ‘সমৃদ্ধি’ নামে একটি প্রোগ্রাম উদ্ভাবন করেছেন তা কেবল পিকেএসএফের পার্টনার অর্গানাইজেশানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পাশাপাশি সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাকাব এবং বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও আরো ব্যাপক ও প্রসারিতভাবে বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। হাওর ও বন্যা দুর্গত এলাকায় কৃষকদের সাহায্য কেবল অর্থ নয় বরং দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার জন্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে উপদেশ ও সেবামূলক সহায়তা ন্যূনতম অর্থের ভিত্তিতে দিতে পারে। তবে এবারের হাওরের দুর্যোগ, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধস এবং বন্যা মোকাবিলায় সরকার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকাকে আরো উন্নত করতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সুসংহত করা জরুরি। নতুন উন্নয়ন মডেলের জন্যে নিয়মিত গবেষণা ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের জন্যে যুগোপযোগী ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। দেশের অগ্রযাত্রায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ডকে শক্তিশালী করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে জোর দিতে হবে। মানব উন্নয়ন সূচক এবং দারিদ্র্যবিমোচন করতে হলে সমাজে ন্যায্যতা এবং সামাজিক উন্নয়নে বণ্টন ব্যবস্থার মান বৃদ্ধি করা এবং গ্রামীণ এলাকায় চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।