যশোর জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ঝিকরগাছা উপজেলা। এই উপজেলায় বাঁকড়া হাজিরবাগ আইডিয়াল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এখানে হাজিরবাগ, বাঁকড়া, নির্বাসখোলা ও মণিরামপুর উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়নের ১২-১৪টি গ্রামের প্রায় দু’শত মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। তাদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন ইন্দ্রজিৎ রায়
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামের আশপাশে মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো স্কুল নেই। গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে বাঁকড়া হাজিরবাগ আইডিয়াল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে। স্কুল বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এ প্রসঙ্গে আবদুস সবুরের মেয়ে সানজিদা নাহার প্রিয়া বলেন, ভ্যান, ইজিবাইকে যাতায়াত করতে প্রথম দিকে দুর্ভোগের শিকার হতে হতো। গ্রামের মেয়েদের বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া দেখে আমিও বাবাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিতে বলি। প্রথমে মা রাজি হলেও বাবার সোজা কথা মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে গেলে লোকে অনেক কথা বলবে। এক পর্যায়ে বাবা রাজি হন সাইকেল কিনে দিতে। এরপর সাইকেল চালানো শিখি। প্রথম দিকে ভয় পেতাম। রাস্তায় কেউ কেউ নানা কথা বলত। এখন আর কেউ কিছু বলে না। বাইসাইকেলে যাতায়াত করায় দুর্ভোগ কমেছে। একইসঙ্গে খরচ ও সময় সাশ্রয় হয়েছে। এখন আর স্কুলে আসতে সমস্যা হয় না।
দল বেঁধে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসি : তামান্না সুলতানা ইভা
বান্ধবী লিলি, বৃষ্টি, তন্বী, সুমাইয়া, অরিন, জুলি সবাই একসঙ্গে দলবেঁধে প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করি। এতে সময়, অর্থ দুই নষ্ট হয় না। স্কুলে অনুপস্থিত থাকি না। কথাগুলো বলছিলেন নবম শ্রেণীর ছাত্রী তামান্না সুলতানা ইভা। ঝিকরগাছা উপজেলার মহেশপাড়া গ্রামের বাবুল হোসেনের মেয়ে ইভা। স্কুল থেকে তার বাড়ির দূরত্ব চার কিলোমিটার। এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় এই স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। যাতায়াতের সুবিধার্থে বাবার কাছ থেকে একটি বাইসাইকেল পেয়েছেন।
তামান্না সুলতানা ইভার মতে, তার বাবা প্রথম দিকে বাইসাইকেল কিনে দিতে রাজি হননি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে দু-তিন মাইল হেঁটে, ভ্যানে, ইজিবাইকে যাতায়াত করতাম। খুব কষ্ট হতো। পরে এলাকার আরও অনেক মেয়েকে সাইকেল চালাতে দেখে বাবা বাইসাইকেল কিনে দেন। পাশের গ্রামে নানার বাড়িতে গিয়ে সাইকেল চালানো শিখি। প্রথম দিকে বাইসাইকেল চালাতে একটু লজ্জা লাগলেও এখন আর লাগে না।
বাল্যবিয়েকে আমি না বলেছি : লিলি সুলতানা
আমাদের পাড়ার আপুরা বাইসাইকেলে চড়ে স্কুলে যাতায়াত করত। তাদের দেখে আমরাও বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছি। প্রথম দিকে কিছু মানুষ খারাপ কথা বললেও এখন আর বলে না। আমরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। বাল্যবিয়েকে না বলেছি। এভাবেই বললেন ঝিকরগাছা উপজেলার মহেশপাড়া গ্রামের কাবিল হোসেনের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী লিলি সুলতানা। লিলি সুলতানা প্রতিদিন চার কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করেন। এখন আর স্কুলে অনুপস্থিত হন না।
প্রতিদিন সময়মতো স্কুলে যেতে পারি : লুবনা আক্তার
ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ থেকে মেধা যাচাই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বছর দেড়েক আগে একটি বাইসাইকেল উপহার পেয়েছে লুবনা আক্তার। সেই বাইসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়া করেন নবম শ্রেণীর ছাত্রী লুবনা আক্তার। ঝিকরগাছার রায়পটন গ্রামের ইসমাইল হোসেনের মেয়ে লুবনা ক্লাসের প্রথম ছাত্রী। নিজের একটি বাইসাইকেল হওয়ায় তিনি মহাখুশি।
লুবনা আক্তার বলেন, আগে স্কুলে হেঁটে না হয় ভ্যানে যাতায়াত করতাম। খুব কষ্ট হতো। বাইসাইকেল হওয়ায় এখন প্রতিদিন সময়মতো স্কুলে যেতে পারি। স্কুলে আসা-যাওয়ায় এখন আর ভাড়া লাগে না। শুধু আমি একা নই, অনেক মেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসেন। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারায় আমরা সবাই খুব খুশি। বাল্যবিয়েকে আমরা না বলেছি। পড়াশোনা করে অনেকদূর এগিয়ে যেতে চাই।
আমি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই : ফাতেমা আক্তার রুমা
বাড়ির আশপাশে মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় ফাতেমা আক্তার রুমা ভেবেছিলেন আর পড়াশোনা হবে না। কিন্তু পড়াশোনার অদ্যম আগ্রহ তাকে থামাতে পারেনি। পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাঁকড়া-হাজিরবাগ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু এতটা পথ ভ্যান, ইজিবাইকে যাতায়াত করতে খুবই অসুবিধা হয়। তাই রুমা বাবাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিতে বলেন।
এ প্রসঙ্গে ঝিকরগাছা উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের আবদুর রবের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী ফাতেমা আক্তার রুমা বলেন, বাবাকে বলি স্কুলের আপুরা সাইকেল চালিয়ে আসেন। আমিও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাব। প্রথম বাবা রাজি হন না। এরপর আমার স্কুলে আসা-যাওয়ার অসুবিধার কথা ভেবে একটি বাইসাইকেল কিনে দেয়। সেই বাইসাইকেলে চড়ে প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়া করি।
স্কুলে অনুপস্থিতির হার বেশ কমে গেছে : তাহেরা আক্তার শান্তা
ঝিকরগাছা উপজেলার ইস্তা গ্রামের আজিজুর রহমানের মেয়ে তাহেরা আক্তার শান্তা নবম শ্রেণীর ছাত্রী। প্রতিদিন সাড়ে চার কিলোমিটার পথ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করেন তিনি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে তাকে একটি বাইসাইকেল কিনে দেয় তার বাবা। তার মতো এলাকার অনেক মেয়ে এখন বাইসাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করেন। এতে সময়, অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। স্কুলে অনুপস্থিতির হার বেশ কমে গেছে। শান্তার মতে, আশপাশে হাইস্কুল না থাকায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই। তার মতো অনেক মেয়ে এখন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসেন। সবাই খুব মজা করে স্কুলে আসেন। লেখাপড়া করে দেশের কল্যাণে কাজ করতে চায়।
কোনো সমস্যা হলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিই : রজব আলী
বর্তমানে স্কুল পর্যায়ে ৩১৭ জন ও কলেজ পর্যায়ে ৯৭ জন ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। তাদের মধ্যে প্রায় ২’শ ছাত্রী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করছে। যাতায়াতের সুবিধা হওয়ায় ক্লাসে অনুপস্থিতির হারও কমেছে। ২০০৫ সাল থেকে মেয়েরা বাইসাইকেলে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া শুরু করে। এরপর পর্যায়ক্রমে এখন প্রায় দুইশ’ ছাত্রী বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। প্রথম দিকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা মেয়েরা রাস্তায় নানাভাবে উত্ত্যক্তের শিকার হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। কোনো সমস্যা হলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিই।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
বাঁকড়া-হাজিরবাগ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ