চট্টগ্রামে হচ্ছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল
ক্রুড অয়েল আনলোডে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্য কম হওয়ায় অপরিশোধিত তেলবাহী (ক্রুড অয়েল ভেসেল) বড় জাহাজ গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করতে বাধ্য হয়। এ কারণে ছোট লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে ক্রুড আনলোডিং (তেল খালাস) করা হয়। এতে অনেক সময় লেগে যায়। অল্প সময়ে তেল খালাস করতে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে রোববার চীনের সঙ্গে একটি প্রকল্প চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অপরিশোধিত তেল খালাস করতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে। বর্তমানে বড় জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে ১২ দিন সময় লাগে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি-২ সম্মেলন কক্ষে ‘ইনস্টলমেন্ট অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে কাঠামোগত চুক্তি করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৫৫ কোটি ৪ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। চুক্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম এবং চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং কিয়াং স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল। চুক্তির আগে অনুদান হিসেবে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি হস্তান্তরে সনদ সই করেন চীনা রাষ্ট্রদূত। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এ প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের জানুয়ারিতে শুরু হবে। এটি বাস্তবায়নে ৩৬ মাস লাগবে। তিনি বলেন, বর্তমানে তেলবাহী জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল আনলোডিং করতে ১২ দিন সময় লাগে। কিন্তু এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে। একই সঙ্গে সিস্টেম লস কমে আসবে। ফলে প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নতুন রিফাইনারিও নির্মাণ করা হবে। এ নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আশা করছি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার সঙ্গে রিফাইনারি তৈরির কাজও শেষ হবে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ থাকলে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে। মানুষের কাছে টাকা থাকবে। তখন বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম কম বা বেশি সেটি কোনো ব্যাপার হবে না। চুক্তি শেষে চীনা রাষ্ট্রদূত কিয়াং বলেন, বাংলাদেশ বন্যা ও খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে আসছে। চীনও এসব দুর্যোগ মোকাবেলা করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম একটি দুর্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ দুর্যোগে বাংলাদেশ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের পাশে আছি। আশা করছি এ সমস্যা যথাসম্ভব দ্রুত ও শান্তিপূর্র্ণ সমাধান হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। আশা করি ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে এর সমাধান বের করে ফেলবে।’ তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতিও হয়েছে। প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
কাজী শফিকুল আযম বলেন, ১০ বছর ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। অবশেষে চীনের অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে। এরপর পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং ঢাকা-সিলেট সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাঠামোগত চুক্তি করা হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ও চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরে সমঝাতা স্বাক্ষর হওয়ার ১১ মাস পর এ কাঠামোগত চুক্তি হল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীন যে পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে তার মধ্যে গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন বা নমনীয় শর্তের ঋণ রয়েছে ৮ কোটি ২৬ লাখ মার্কিন ডলার। বায়ার্স ক্রেডিট অর্থাৎ কিছুটা কঠিন শর্তের ঋণ রয়েছে ৪৬ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলার। ঋণের ফ্লাট সুদের হার হবে ২ শতাংশ। এর সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ প্রতিশ্রুতি ফি এবং শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ফি দিতে হবে। এছাড়া ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (রেয়াতকাল) ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সূত্র জানায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোতে বড় ক্রুড ভেসেল হ্যান্ডেল করা সম্ভব নয়। কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্য কম হওয়ায় বড় ক্রুড ভেসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা হয়। এরপর ছোট লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে ক্রুড আনলোডিং করা হয়। এসব সমস্যা হতে উত্তরণের জন্যই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হল- পাইপলাইন ও সিঙ্গেল মুরিং টার্মিনাল নির্মাণ করা। অফশোরে ১৪৬ কিলোমিটার ও অনশোরে ৭৪ কিলোমিটারসহ ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন (এর মধ্যে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ৩২ কিলোমিটার এবং ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের ১৮৮ কিলোমিটার) করা হবে। মহেশখালী দ্বীপে ট্যাঙ্ক ফার্ম ও পাম্প স্টেশন স্থাপন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ, বিশেষজ্ঞ সেবা এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ও সংশ্লিষ্ট কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।