বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে উন্নয়নের আরেক মাইলফলক

গত ২৬ অক্টোবর একটি দৈনিকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে পদ্মার দক্ষিণ পারে বিষয়ক সংবাদটি পড়ে খুবই ভালো লাগল। বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্য ও বাস্তবিক অর্থেই আন্তর্জাতিক মানের একটি বিমানবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এ ব্যাপারে দ্বিমত করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।

যাই হোক, এ বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্যই আমার আজকের লেখাটি।
সম্ভবত ২০০৯ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার আড়িয়াল বিল এলাকায় প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অত্যন্ত আধুনিক ও বিশ্বমানের একটি বিমানবন্দর নির্মাণের চিন্তাভাবনা থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। হয়তো দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে এই বিমানবন্দরটি হবে অন্যতম বিমান পরিচালন কেন্দ্রবিন্দু—এ অনুভব থেকেই তিনি ওই চিন্তা করেছিলেন। তখন বেশ কয়েকটি কারণেই বিমানবন্দরটি নির্মাণের জন্য আড়িয়াল বিল এলাকাটিকে উপযুক্ত মনে করা হয়েছিল। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক স্থানীয় জনগণকে ভুল বোঝানোর পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় ব্যাপক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ফলে ওই স্থানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এরপর শুরু হয় আবার নতুন করে স্থান নির্বাচনের পালা। এ ঘটনাগুলো যখন ঘটে আমি তখন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার।

আমরা সেই সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে কয়েকবারই মালয়েশিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে সরাসরি আলোচনা করেছেন। আশা করা হয়েছিল মালয়েশিয়া সেতুটি নির্মাণ করবে। যাই হোক, দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারেনি। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই সেটি তৈরি হচ্ছে। সেই ইতিহাস আর টানছি না। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রসঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তাঁর দৃঢ়তা প্রকাশ করেন। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া সফল হতে না পারায় আমি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে মালয়েশিয়ার দু-একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে যোগাযোগ করলেও পরে আর এগোতে সাহস পাইনি। কিন্তু আমি মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম বিমানবন্দরটি নির্মিত হোক।
যতটুকু মনে পড়ে আড়িয়াল বিল এলাকায় বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় তখন থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মার দক্ষিণ পারে, বিশেষ করে পদ্মা সেতুর নিকটবর্তী কোনো সুবিধাজনক স্থানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চিন্তাভাবনা করছিলেন। কারণ সেটি হবে মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের কেন্দ্রে, অর্থাৎ মধ্যবর্তী স্থানে। আমরা জানি, পদ্মা সেতুর দক্ষিণ পারের একদিকে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা, অন্যদিকে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা। সেতুর পূর্ব পাশের চেয়ে উত্তর-পশ্চিম পাশের চর এলাকা নানা কারণে, বিশেষ করে আয়তনের দিক থেকে সুবিধাজনক। ওখানে কমপক্ষে ৩০ বর্গকিলোমিটারের বেশি আয়তনের একটি এলাকা নদী থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। ফসলি বা ব্যক্তিগত জায়গাজমি হুকুমদখল করার তেমন একটা প্রয়োজন পড়বে না। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা হবে খুবই সীমিত। এ ছাড়া নদী শাসনের অর্থাৎ পদ্মা সেতুর জন্য নদীর তীর রক্ষার যে বাঁধ নির্মাণ করা হবে, তা বিমানবন্দরের প্রয়োজন অনুযায়ী বর্ধিত করে একই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় রাখা যাবে। আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে নদী থেকে উদ্ধারকৃত জমি বালুকাময় হওয়ায় সম্ভবত ওই মাটিতে নির্মাণকাজ শুরু করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার দরকার পড়বে না। সর্বোপরি ভবিষ্যতে বিমানবন্দরের আয়তন বাড়ানোর প্রয়োজন হলে তা-ও সম্ভব হবে।

ওই এলাকায় বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা হলে অতি সহজেই ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের সঙ্গে একটি ছোট্ট সংযোগ সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত করা যাবে। এ ছাড়া রেলওয়ে সুবিধার জন্য সেতুর জাজিরা পয়েন্টে ‘বিমানবন্দর স্টেশন’ নামে একটি ট্রেনস্টেশন নির্মাণ করা যেতে পারে। সর্বোপরি নদীপথে মালামাল পরিবহন করার রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। এ জন্য বিমানবন্দরের পাশে উপযুক্ত স্থানে একটি কার্গো বা কনটেইনার ডিপো ছাড়াও একটি অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর নির্মাণ করা যেতে পারে।

আমার মনে হয়, শিবচরের ওই চর এলাকায় প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা হলে তা আমাদের জন্য অনেক সহজ, সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক হবে। উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হতে পারে—১. ভূমি হুকুমদখল ও তদসংক্রান্ত ব্যয় হবে ন্যূনতম। কারণ ওই এলাকায় জনবসতি খুব কম। এ ছাড়া পদ্মা নদী থেকে পুনরুদ্ধার করা জমির সবই থাকবে খাসজমি হিসেবে সরকারের জমি। ২. বর্তমানে কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ খুবই কম। বেশির ভাগ এলাকা বালুকাময় এবং বছরের বেশি সময় পানির নিচে ডুবে থাকার কারণে চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। ৩. স্থানটি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত থাকবে। বরিশাল ও খুলনা বিভাগ সংযুক্ত থাকবে যথাক্রমে ফরিদপুর-বরিশাল ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মাধ্যমে। উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ দুটিকে সংযুক্ত করবে লালন সেতু। বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে সরাসরি সংযুক্ত করতে হলে ভবিষ্যতে চাঁদপুর ও শরীয়তপুর জেলাদ্বয়কে সংযুক্ত করতে হবে মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করে। মেঘনা সেতু নির্মিত হলে চট্টগ্রাম সরাসরি দক্ষিণ ও উত্তর বাংলার সঙ্গে সংযুক্তি পাবে। ৪. বিমানবন্দরটি ঘিরে অতি সহজেই গড়ে উঠবে নৌ পর্যটনের নানা সুযোগ-সুবিধা। ট্রানজিট যাত্রীদের কাছে এটি হতে পারে আকর্ষণীয়, অর্থাৎ তাদের বিনোদনের জন্য নৌ পর্যটন অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া বিমানবন্দর ঘিরে হোটেল নির্মিত হবে, গড়ে উঠবে শহর আর শহরতলি। ৫. বিমানবন্দরের আশপাশে রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কারণ জল, স্থল ও আকাশপথে পণ্য পরিবহনের এমন সুযোগ বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরে নেই। ৬. বিমানবন্দরটি প্রত্যক্ষভাবে বেশ কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। আর পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ লোক কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পাবে। ৭. স্থানটি বাংলাদেশের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় এবং যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধার কারণে প্রতিটি জেলার মানুষের কাছেই সমান গুরুত্ব পাবে। ৮. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর যোগাযোগ সহজ ও সুলভ করার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বিমানবন্দরটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। ৯. পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের বিমানবন্দরই রাজধানী শহর থেকে বেশ দূরে (গড়ে ৫০ থেকে ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত)। সেই হিসাবে শিবচরের ওই স্থানটি হতে পারে একটি উপযুক্ত পছন্দ।

আমরা জানি, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ টার্মিনালসম্পন্ন হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি প্রায় ১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের, যার সবই পুনরুদ্ধার করা ভূমির ওপর। ১৯৯৮ সালে নির্মিত ওই বিমানবন্দরটি নির্মাণে সময় লেগেছিল মাত্র ছয় বছর। প্রায় একই আয়তনের জমির ওপর নির্মিত সিঙ্গাপুরের চাংগি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বিমান পরিচালনকেন্দ্র। আর ওই বিমানবন্দরেরও প্রায় সম্পূর্ণ জায়গাই সাগর থেকে উদ্ধার করা। প্রতিটি বিমানবন্দর থেকেই বছরে কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন যাত্রী আসা-যাওয়া করে।

হংকং বা সিঙ্গাপুর যদি এত বছর আগে সাগর থেকে মাটি উদ্ধার করে বিমানবন্দর নির্মাণ করতে পারে, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই শিবচরের ওই চরাঞ্চলে পদ্মা নদী থেকে জমি উদ্ধার করে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নির্মাণ করতে কৃতকার্য হব। আমার বিশ্বাস, বিমানবন্দরটি নির্মাণে বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসবে। পদ্মা সেতুর মতোই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরেকটি সাহসী পদক্ষেপ হবে এ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি তিনি এভাবেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন—এটাই জাতির প্রত্যাশা।