ওই ডাকেরে হেমন্ত

হেমন্ত বাংলাপথে পা ফেলেছে মাত্র কয়েকদিন হলো। প্রকৃতিতে হেমন্তের আবির্ভাব মুহূর্তটা রোদের চাকচিক্যতা আর ঋতুনন্দিনীর লাস্যময়ী রূপে রঙিন অষ্টাদশী যুবতীর মতোই যৌবনের শিহরণ জাগানিয়া ভাবাবেগে ছিল পূর্ণ। কার্তিকের কাদামাটির গন্ধ, শাপলা-শালুকের বিদায়ী আবাহন, চারপাশে পক্ষী কূজন, উত্তরের হিম হাওয়া এবং কৃষাণী ঘরে নবান্ন আয়োজনসহ নানা ঢঙে ভর করে নৈসর্গিক রথে চড়ে বাংলা গদিতে আসন গেড়েছে ঋতুতনয়া। হেমন্ত আগমনের লগ্নে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে অনন্ত যৌবনায় ভরপুর ঋতুকন্যা তার চিরচেনা রূপ মাধুর্যের সাবলীল ভঙ্গিমা প্রদর্শন করতেই বুঝি এই বঙ্গদেশে হেমন্তের আগমন। তবে সম্প্রতি কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি যেন হেমন্তের সব অহঙ্কারী দর্শনীয় সজ্জায় দিয়েছে পানি ঢেলে। প্রকৃতির এ বালখিল্লেপনা ঋতুবৈচিত্র্যের বাহারি পর্দায় অসন্তুষ্টির জল ছিটিয়ে সব সুন্দরকে অসুন্দরে পর্যবসিত করে যাচ্ছে বারবার। প্রকৃতিগত এমন বৈরিতা মাঝে মাঝে ঋতুচক্রের ঐতিহ্যগত ভারধারায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এগুলো মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগের বহিঃপ্রকাশ।ঋতুপরিক্রমার প্রতিটি ভাঁজে মিশে আছে বৈচিত্র্যতা। নানারূপে চিত্রিত সেই ঋতু মাধুর্যতায় মুগ্ধ লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা যুগে যুগে রচিয়েছেন গল্প, কবিতা, গান।

হেমন্তের রূপ আমি দেখেছি পথে পথে। যেতে যেতে অবলোকন করেছি মনোরম সাজে সজ্জিত ঋতুকন্যার জলুসপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। কত সুন্দর, কত মনোহর সেই দৃশ্য। হেমন্ত আমায় ধরে রাখতে গিয়ে পিছু ডেকেছে বারবার। হেমন্তের এত মহিমা দুহাতে সরিয়ে জীবনের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করতে ছুটতে হয়েছে কর্মপথে। পল্লীপাড়ার হৈমন্তী কোলাহল ছেড়ে অল্পক্ষণের জন্য জেলা শহর সুনামগঞ্জে যেতে হয়েছিল এই লেখিয়ে অঙ্গকে। সম্প্রতি জামালগঞ্জ উপজেলা সদর সাচ্না বাজারের সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে যখন রওনা দিই ঘড়িতে সময় তখন প্রায় দুপুর বারোটা। চারপাশে রোদের হলুদ ঝলকানি। সড়কে ছিল ছোট ছোট ডাঙাযানের আসা-যাওয়ার মিছিল। চেপে বসা তিন চাকা গাড়ির দ্রুত বেগে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটা মুহূর্ত যেন আমায় ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে।সড়কের দুপাশে সবুজের হাতছানি। কোথাও বিলঝিল-ডোবানালা, কোথাও খোলা মাঠ, আবার কোথাও বনোঘাস গুল্মলতায় আচ্ছাদিত ভূমি। পথের কিনারে বয়ে চলা ফসলি জমি ও পরিত্যক্ত জলাশয়ের ওপর বৈদ্যুতিক তারের লম্বা সারিতে দেখা মেলে ঘুঘু পাখির দলবদ্ধ আয়োজন। এক কাতারে বসা ঘুঘু দলের নীরব প্রতীক্ষা যেন হেমন্তের প্রকৃতি ও পরিবেশকে আরও মনোমুগ্ধকর রূপে সবার সামনে তুলে ধরেছে। রবি রাজার তপ্ত তেজ ওই পক্ষীপ্রজাতিকে স্নান করিয়ে নৈসর্গিক তৃপ্তি এনে দেওয়ার মিশনে যুক্ত হয়েছে। একটু দূর থেকে চোখে পড়া সারিবদ্ধ ঘুঘুগুলো যেন গভীর মমতায় ডেকেছে মোরে।একপ্রান্ত ছেড়ে যখন অন্যপ্রান্তে চোখ চলে তখন প্রকৃতির ভিন্নরকম নাচানাচি নিজেকে আরও উদ্বেলিত করে তোলে। ব্যস্ত পথে চলতে চলতে হঠাৎ দৃষ্টিতে আসে লম্বা গলাওয়ালা সাদা বক। শুকনো আধা শুকনো চরে খাদ্য সংস্থানে উদগ্রীব গরুর পেছন পেছন হাঁটছিল ক্ষুধার্ত বকের সফেদ পাল। এগুলো ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই দেখতে পাই বিস্তর সবুজ মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য তৃণভোজী প্রাণী অর্থাৎ গরু, ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়ার চোখ ধাঁধানো প্রতিচ্ছবি। ওই গবাদিপশুগুলো ক্ষুধা নিবারণের অভিপ্রায় মাথা নুয়ে ধীরগতিতে হেঁটে চলেছে। এ যেন কোনো চিত্রকরের নিপুণ হাতে আঁকা আমার বাংলা গাঁয়ের অপরূপ চিত্র প্রদর্শন বৈকি। শুধু তাই নয়, যেতে যেতে দেখা হয় কার্তিকের শুকিয়ে আসা ডোবাঝিলে পুরনো পানির ওপর নিভৃতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট অসংখ্য সাদা ফুল। শাপলাজাতীয় এ ফুল হেমন্তের গৌরব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া রাস্তার পাশে শরতের শুভ্রভূষণ কাশের নাচন সদ্যবিদায়ী ঋতুরানিকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।হেমন্তের এমন সাজসজ্জা মাড়িয়ে যখন সুনামগঞ্জের প্রবেশদ্বার স্রোতস্বিনী সুরমার ওপর নির্মিত আব্দুজ জহুর সেতুতে উঠি তখন দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির ছোঁয়া লাগে মোর দেহ ও প্রাণে। গেঁয়োপ্রান্তের হেমন্ত জাল ছিন্ন করে শহুরে পরিবেশে প্রবেশ করামাত্রই মনে জাগে গ্রাম আসলে কতটা শান্তি ও সন্তুষ্টির পরিশুদ্ধতম অঙ্গন। ব্যতিব্যস্ত শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে সতত ভাবি বঙ্গগাঁয়ের বৃক্ষতরু গুল্মলতাদিতে পরিপূর্ণ সবুজ আঁচল মায়ের পরম মমতায় আগলে রাখা সন্তানের পরিতৃপ্তিবোধসম্পন্ন সত্তার মতোই শ্রেষ্ঠ এবং মহান। এক কথায় হেমন্তের উদাসী প্রকৃতি ও তার অপূর্ব মাধুরিমা আমায় সজোরে স্পর্শ করেছে। এই মন ছোঁয়া নিসর্গ নর্তন যে কাউকে বেঁধে রাখবে আপন মহিমায়। আমি গেঁয়ো পরিচয়ের একজন নিখাদ মানুষ হিসেবে বলব, এ জন্যই গ্রাম আমার কাছে তীর্থভূমি। তীর্থক্ষেত্রে পুণ্যার্থীরা যেমন পরকালের মঙ্গল কামনায় মাথা ঠুকে বিধাতার সান্নিধ্য লাভে মরিয়া হয়ে ওঠে, তেমনি এই গ্রামের পবিত্র অঙ্গন আমায় তীর্থভূমের কথাই প্রতিবার স্মরণ করিয়ে দেয়।অবশেষে বলবÑ গ্রাম, ওরে গ্রাম আমি বাঁচব তোমায় জড়িয়ে, আমি মরবও তোমায় জড়িয়ে, মনেতে যে এ বাসনাই পুষি শতবার। গ্রাম কতটা প্রিয় তা লেখিয়ে অস্তিত্বের সর্ববোধশক্তি দিয়েও বুঝিয়ে বলার সামর্থ্য অন্তত নেই আমার। শহরে কাটানো পনেরোটা বছর প্রতিবার প্রতিক্ষণ গ্রাম্য অভাব পুড়িয়েছে আমায়। গ্রাম সম্পর্কে কেউ বিদ্বেষপূর্ণ কিছু বললেই যেন মনে হতো এ অঙ্গে কাঁটা লেগেছে। সর্বশেষ গ্রামবিদ্বেষীদের উদ্দেশে বলব, যারা গ্রামে জন্মে গ্রামকেই অস্বীকার করে তারা বিলাসিতার মোহে আড়ষ্ট অস্বস্তিদায়ক শহুরে সানাই হিসেবে বিবেচিত।য় বিশ্বজিত রায় : কলাম লেখকbishwa85@gmail.com