ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র বিশাল মজুদের সম্ভাবনা

ভোলার বিদ্যমান শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে আরেকটি নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে। মাটির তিন হাজার ৪০০ মিটার গভীরে আট মিটার পুরু বিস্তীর্ণ স্তরে গ্যাস রয়েছে বলে জানিয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার বিষয়টি গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়।

বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি বলেন, এটা দেশের জন্য বড় সুসংবাদ। আগে থেকেই শাহবাজপুরে যে কূপটি রয়েছে, সেটা মিলে ওই এলাকায় বর্তমানে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন গ্যাসপ্রাপ্তির সংবাদে প্রধানমন্ত্রী বাপেক্সসহ এ আবিস্কারের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।

পেট্রোবাংলা মনে করছে, প্রাথমিক হিসাবে এখানে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস থাকতে পারে। এর মধ্যে তোলা যাবে কমবেশি ৮০ ভাগ। গত কয়েক বছরে যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিস্কার হয়েছে, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। অনুসন্ধান কূপ খননকালে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ ও গ্যাসস্তরের আয়তন সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে, সে হিসেবে সেখানে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস থাকতে পারে বলে পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে। নতুন আরও কূপ খননের পর মজুদ আরও বাড়তে পারে।

এই কূপ খনন করার কথা ছিল বাপেক্সের। কিন্তু সরকার শাহবাজপুর পূর্ব-১ নামে এই অনুসন্ধান কূপটি খনন করার জন্য ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব দেয় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমকে। তবে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব থাকে বাপেক্সের হাতে। গত ৬ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ খননকাজের উদ্বোধন করেন। গতকাল সোমবার সেখানে গ্যাস পাওয়ার কথা জানানো হলো।

তবে গ্যাসের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ও উত্তোলনযোগ্য মজুদপ্রাপ্তির বিষয় পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নওশাদ ইসলাম। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর এটি হবে দেশের ২৭তম গ্যাসক্ষেত্র।

বাপেক্সের এমডি আরও জানিয়েছেন, নতুন এই গ্যাসক্ষেত্রের অবস্থান বোরহানউদ্দিন উপজেলার টগবি ইউনিয়নে, যা শাহবাজপুরের বর্তমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে। গ্যাসপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার পরীক্ষা ডিএসটি (ড্রিল স্টিম স্টেট) ছাড়া কীভাবে গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার দাবি করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনুসন্ধান কূপ খননকালে প্রাপ্ত লগ রিপোর্ট বিশ্নেষণ করে বোঝা যাচ্ছে, এটা একটা বড় গ্যাসক্ষেত্র। আরও যাচাই-বাছাইয়ের পর উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ জন্য সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র না পুরনো গ্যাসক্ষেত্রের বর্ধিতাংশ, কোনটা বলা উচিত- এমন প্রশ্নের জবাবে নওশাদ ইসলাম বলেন, পুরনো কূপ থেকে নতুন কূপের দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। সাধারণত একটি কূপকে কেন্দ্র করে এর চারপাশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকাকে একটি গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয়। তাই বলা যায়, এটা নতুন গ্যাসক্ষেত্র হতে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, খুব তাড়াতাড়ি পুরনো ক্ষেত্র ও নতুন ক্ষেত্রের মাঝামাঝি আরও কূপ খনন করা হবে। সেখানে যদি দেখা যায়, মাটির নিচে নতুন ও পুরনো গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে সংযোগ রয়েছে, তাহলে বলতে হবে এটা একটা অতি বিশাল গ্যাসক্ষেত্র। কারণ, মাটির নিচে এত বিশাল এলাকায় গ্যাসাধার থাকলে সেটা কয়েক টিসিএফ হতে পারে।

নতুন গ্যাসক্ষেত্র পুরনোটার বর্ধিতাংশ কি-না এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাপেক্সের এক কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জানান, সাধারণত তিন ধরনের কূপ খনন করা হয়। একটি হলো অনুসন্ধানী কূপ। এই কূপ খনন করে গ্যাস পাওয়া গেলে তাকে বলা হয় নতুন গ্যাসক্ষেত্র। ভোলায় যেটা করা হয়েছে, সেটা অনুসন্ধানী কূপ। এ জন্য এটিকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র বলা হচ্ছে। তা ছাড়া যেহেতু শাহবাজপুর থেকে এটি সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে, সেহেতু ধারণা করা হচ্ছে, নতুন এ ক্ষেত্রের সঙ্গে পুরনোটার সংযোগ নেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে উন্নয়ন কূপ। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যখন কোনো গ্যাসক্ষেত্রে নতুন একটি কূপ খনন করা হয়, তখন তাকে বলা হয় উন্নয়ন কূপ। যেমন- তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে অনেক কূপ আছে। সেখানে একটিই মাত্র অনুসন্ধান কূপ, বাকিগুলো সবই উন্নয়ন কূপ। তৃতীয়টি হচ্ছে মূল্যায়ন কূপ। কোনো গ্যাসক্ষেত্রে মাটির নিচের তথ্য নতুন করে যাচাই-বাছাই করার জন্য যখন কূপ খনন করা হয়, তখন তাকে বলা হয় মূল্যায়ন কূপ।

পেট্রোবাংলার একজন ভূতাত্ত্বিক জানান, সাধারণত একটি নতুন ক্ষেত্রে গ্যাস পাওয়ার পর উঁচু পাইপে আগুন ধরানো হয়। যাকে বলা হয় গ্যাসফায়ার। এটার মাধ্যমেই একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়। ভোলা নতুন ক্ষেত্রে এখনও গ্যাস ফায়ার করা হয়নি। কিন্তু আগেভাগেই গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। এটা এক সপ্তাহ পরে দিলেই ভালো হতো। তিনি আরও জানান, গত কয়েক বছরে পেট্রোবাংলা থেকে কয়েকটি ক্ষেত্রে গ্যাস পাওয়ার আগাম ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ঘোষণার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি। সুনেত্র, সুন্দলপুর ও হরিপুরে আগাম তেল-গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় পেট্রোবাংলা। যদিও এর কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য পাওয়া যায়নি। হরিপুরে তেল ও সুনেত্রে গ্যাস মেলেনি।

সূত্র জানিয়েছে, ভোলার এই কূপের প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবে (ডিপিপি) তিন হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত খননের কথা বলা হয়। কিন্তু থ্রিডি সিসমিক সার্ভের তথ্যের ভিত্তিতে গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সাড়ে তিন হাজার মিটার খননের চুক্তি করা হয়। পরে তিন হাজার ৪০২ মিটার থেকে চার হাজার ৪১০ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় গ্যাস থাকার তথ্য মেলে। গত সপ্তাহে খননযন্ত্র এই গভীরতায় পৌঁছেছিল।

শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটি বেঙ্গল বেসিনভুক্ত। সেখানে মাটির গভীরে যে ভূ-কাঠামোয় গ্যাস পাওয়া গেছে, তার ভূতাত্ত্বিক নাম ‘স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার’। দেশের অন্য সব গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনে। এই বেসিনের ভূতাত্ত্বিক নাম ‘অ্যান্টিক্লেইন স্ট্রাকচার’।

বলা হচ্ছে, ভোলার এই গ্যাসক্ষেত্র সাম্প্রতিককালের মধ্যে আবিস্কৃত অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র। এর আগে ২০১৪ সালের জুনে দেশে ২৬তম গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করে বাপেক্স। আকারে ছোট ওই ক্ষেত্রে ৫০ বিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। এর আগে কুমিল্লার শ্রীকাইলে ২৫তম গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করে বাপেক্স। ২০১২ সালের জুলাইয়ে আবিস্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্রে ৩০০ বিসিএফ গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য মজুদ রয়েছে।

ভোলায় গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কারের জন্য প্রথম ভূকম্পন জরিপ চালানো হয় ১৯৮৬-৮৭ সালে। প্রথম অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর আরও তিনটি কূপ খনন করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ১১ মে থেকে এই ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে বাপেক্স। সেখানে থাকা চারটি কূপের মধ্যে তিনটি থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। ২০১৬ সালে এ এলাকায় আবার ত্রিমাত্রিক জরিপ চালায় বাপেক্স। এতে ভোলায় বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অবস্থান রয়েছে বলে তথ্য-উপাত্তে পাওয়া যায়। বিদ্যমান শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভে গ্যাস থাকার সম্ভাবনার কথা জানানো হয় তখন।

এর আগে আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কোম্পানি ইউনোকল এক জরিপের ভিত্তিতে বলেছিল, শাহবাজপুরে দুই টিসিএফ গ্যাস মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে ভোলায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (২২৫ ও ৩৫ মেগাওয়াট) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদেরও গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।