ভিয়েতনাম থেকে আনা ওপি জাতের নারকেল গাছ ॥ মাত্র ৩০ মাসেই ফলন

দেশে ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত উন্নত ও খাটো (ওপি) জাতের নারকেল গাছে প্রথমবারের মতো ফল ধরতে শুরু করেছে। দেশী ও প্রচলিত জাতে ৭ থেকে ৮ বছরের মাথায় ফল এলেও উন্নত ওপি জাতের গাছগুলোতে মাত্র ৩০ মাসের মাথায় ফল ধরেছে। গাজীপুর, নাটোর ও সাভারের রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারের ৩টি গাছে নারকেল ধরতে শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আহমেদপুরে দুই বিঘা জমিতে গড়ে তোলা উন্নত জাতের এক নারকেল বাগানেও ফুল আসি আসি করছে। একই অবস্থা সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে তোলা একাধিক বাগানের। নারকেল চাষী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ গোলাম মারুফ জনকণ্ঠকে বলেন, ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত উন্নতজাতের নারকেল গাছে ফল আসার ঘটনাটি অবশ্যই ইতিবাচক। দেশীয় জাতের গাছগুলো আকারে লম্বা হওয়ায় অনেক সময় পরিচর্যা করা যায় না। তবে খাটো জাতের এ গাছগুলোতে পরিচর্যার সঙ্গে সঙ্গে বালাই ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব। এতে দেশে নারকেলের উৎপাদন বাড়তে পারে। আর বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. মোঃ মেহেদী মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশীয় জাতের নারকেল গাছে প্রথমবার ফল ধরতে ৮ থেকে ১০ বছর লাগে। তবে ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত ওপি জাতের গাছে মাত্র ৩০ মাসে ফল ধরেছে। এটি নারকেল প্রেমীদের জন্য সুখবরও বটে।

তথ্যমতে, সরকারী হিসেবে দেশে প্রতিবছর ৬৩ থেকে ৬৪ লাখ নারকেল উৎপাদন হয়। তবে দেশের চাহিদা পূরণে তা যথেষ্ট নয়। বিপরীতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডাবের চাহিদা। এর সুস্বাদু পানীয় রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় নারকেল গাছকে অনেকে ‘স্বর্গীয় গাছ’ হিসেবেও আখ্যা দেন। চাহিদা বিবেচনায় ৬০ শতাংশ নারকেল গাছই ডাব উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে চারা তৈরিতে নারকেলের সঙ্কট দেখা দেয়। এছাড়া দেশীয় ও প্রচলিত জাতের নারকেল গাছ লম্বা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে তা ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি বেশি। সমুদ্র উপকূলে সামান্য ঝড়েই ভেঙ্গে পড়ে হাজার হাজার নারকেল গাছ। আইলা ও সিডরের সময় এই ঝুঁকি ছিল অনেকটা মহামারীর মতো। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিকল্প নিয়ে ভাবতে থাকেন। তখন সরকারী উদ্যোগে একটি দল পাঠানো হয় ভিয়েতনামে। সেই দলের সদস্যরাই প্রথমে কয়েকটি গাছ সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। পরে তা লাগানো হয় হর্টিকালচার সেন্টারে। ধারাবাহিকতায় বেসরকারীভাবেও একাধিক স্থানে গড়ে উঠে উন্নতজাতের নারকেল বাগান। ক্রমেই তা সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর সেসব বাগানেরই কোন কোনটিতে ফল এসেছে। আবার কোনটিতে ফুল আসি আসি করছে।

প্রায় ৩ বছর আগে ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত ওপি জাতের ৮টি চারা রোপণ করেন নাটোরের এসএম কামরুজ্জামান। শহরের ফুলবাগান এলাকায় তার করা বাগানের একটি গাছে ফল এসেছে জানিয়ে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘নাটোরে ৮টি চারা লাগালেও দেশের বাড়ি পাবনায় আরও ২০টি চারা লাগিয়েছি। এর মধ্যে নাটোরের ফুলবাগানে সিয়াম ব্লু জাতীয় একটি গাছে ফল এসেছে। আর সিয়াম গ্রীনেও ফুল আসি আসি করছে।’ তিনি বলেন, ‘নারকেল গাছে ৩০ থেকে ৩২ মাসে ফল দিতে শুরু করা সত্যিই অবিশ্বাস্য।’ পরিচর্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আরও বলেন, ‘উন্নতজাতের এ গাছগুলো এমন স্থানে লাগাতে হবে যেখানে সব সময় রোদ পড়ে। ছায়া আছে এমন স্থানে না লাগানোই উত্তম। আর এ ধরনের নারকেল চাষে প্রচুর খাবার দিতে হয়।’ আর সাভারের রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারের একটি গাছে ফল এসেছে জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সিনিয়র উদ্যানতত্ত্ববিদ খন্দকার মোঃ মাসুদ রানা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘৩০ মাস আগে সরকারীভাবে যখন আমাদের ভিয়েতনাম পাঠানো হয় তখন সেখান থেকে আমরা ওপি জাতের ২টি চারা নিয়ে আসি। এর মধ্যে সাভারের রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারে লাগানো একটি গাছে ডাব এসেছে।’ গাজীপুর শহরে লাগানো একটি গাছেও ডাব এসেছে বলে জানিয়েছেন বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. মোঃ মেহেদী মাসুদ।

আর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আহমেদপুরে ২ বিঘারও কিছু বেশি জমিতে উন্নতমানের ওপি ও হাইব্রিড জাতীয় ১০৫টি নারকেলের চারা রোপণ করেছেন সেলিম রেজা। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘২০১৫ ও ২০১৬ সালে পর্যায়ক্রমে নারকেলের চারাগুলো রোপণ করেছি। একই বাগানে শরীফা ফলের কিছু গাছও রয়েছে। পরিচর্যার ক্ষেত্রে গাছের পাশে গোলাকার বৃত্তের শেষ সীমানায় সার প্রয়োগ করতে হয়। দিতে হয় পোড়ামাটি। আর গাছগুলো পরিষ্কার রাখতে হয়। কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিÑ বর্তমানে কয়েকটি গাছে ফুল আসার লক্ষণ দেখা দিয়েছে।’ জানালেন, বাগানে এখন কিছু শরীফা ফলের গাছ থাকলেও ভবিষ্যতে এটিকে তিনি নারকেলের বাগান হিসেবেই গড়ে তুলবেন। আর উন্নতজাতের নারকেল চাষে তিনি বেশ আশাবাদীও।

তথ্যমতে, দেশীয় জাতের নারকেল গাছগুলো আকারে বেশ লম্বা। চারা রোপণের ৭ থেকে ৮ বছর পর দেশীয় জাতের নারকেল গাছে ফুল আসে। আর বছরে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০টি ফল হয়। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে লম্বা জাতের নারিকেল চাষের জনপ্রিয়তাই বেশি। তবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগুলোর ঝড়ো হাওয়া সহনশীলতা নেই বললেই চলে। ফলে আইলা বা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি হয় হাজারো নারকেল গাছের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, খাটো ও আধুনিক জাতগুলো অল্প সময়ে ফল দেয়া আরম্ভ করে। এর ফলদান ক্ষমতাও অনেক। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড়ে গাছগুলো ভেঙ্গে পড়ে না। দেশী জাতের গাছগুলো বছরে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০টি ফল দিলেও ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত সিয়াম গ্রীন কোকোনাট ও সিয়াম ব্লু কোকোনাট জাতের গাছে গড়ে ২০০ পর্যন্ত নারকেল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত ওপি জাতের নারকেল থেকে কৃষক নিজেরাও চারা তৈরি করতে পারবে। তবে ভারত থেকে সংগৃহীত হাইব্রিডের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না।

সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ উন্নতজাতের নারকেলের চারা ঢুকেছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম থেকে সংগ্রহ করা উন্নতজাতের ওপি চারার সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার। বাকি ১০ হাজার এসেছে ভারতের কেরেলা থেকেÑ যা হাইব্রিড প্রজাতির। তবে সরকারের লক্ষ্য রয়েছে প্রায় ১০ লাখ চারা আমদানির। দেশের যে কোন কৃষি অফিস বা সরকারী হর্টিকালচার সেন্টার থেকে উন্নতজাতের নারকেলের চারা সংগ্রহ করা যাবে। কৃষিবিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের পতিত জায়গায় অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ কোটি নারকেলের চারা লাগানো যাবে। তাদের মতে, সমপরিমাণ না হয়ে এর অর্ধেক গাছ লাগানো সম্ভব হলেও তবে তা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যাবে। নারকেল উৎপাদন হয় এমন ১৭ দেশের সংগঠন এশিয়া প্যাসিফিক কোকোনাট কমিউনিটি। সংগঠনটির মতে, নারকেল উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। অনুকূল পরিবেশের কারণে দেশের সর্বত্রই নারকেলের চারা লাগানো সম্ভব বলে মনে করে সংগঠনটি। তবে বাংলাদেশে এখনও এই সংগঠনের সদস্য হতে পারেনি। পর্যালোচনায় রয়েছে। কৃষিবিদরা মনে করেন, দেশে নারকেল উৎপাদনের প্রসার ঘটলে সংগঠনটির ১৮তম সদস্য হতে পারে বাংলাদেশই।