কৃষি ও চিকিৎসায় দেশের বিজ্ঞানীদের অভাবনীয় সাফল্য ॥ যুগান্তকারী ৩ উদ্ভাবন

উদ্ভাবনী শক্তিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সেবাধর্মী নিত্য-নতুন উদ্ভাবনে উপকৃত দেশের প্রান্তিক মানুষ। গবেষকদের এমন সাফল্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সমাদৃত বিশ্বব্যাপী। বিশ^কে তাক লাগিয়ে দেয়া এমন সফলতা আসছে দেশের কৃষি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের হাত ধরে। দেশীয় চিকিৎসকের উদ্ভাবিত নিউমোনিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’ টেক্কা দিতে চলছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মানকেও। শ্যাম্পুর বোতলে তৈরি এই ডিভাইস অক্সিজেন প্রদাহের ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়েও ৭৫ শতাংশ অধিক শিশুর মৃত্যু রোধ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে এটি সাশ্রয়ীও। দেশের প্রতিটি হাসপাতালে ড. চিশতীর এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হলে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় শিশুমৃত্যুর হার শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। আর কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিত্য-নতুন জাতের উদ্ভাবন প্রক্রিয়া চলমান। বৈশিষ্ট্য ও গুণে প্রচলিত কোন একটি জাতকে পেছনে ফেলার মতোও নতুন জাত আসছে হরহামেশা। তবে সাফল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আকস্মিকভাবে কোন একটি রোগ ছড়িয়ে পড়লে তার পরের বছরই ওই রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনেও সক্ষম হচ্ছেন দেশের বিজ্ঞানীরা। এতে সহজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে। সম্প্রতি গমের এমনই একটি জাত উদ্ভাবন হয়েছে যা দেশে ২০১৬ সালে ছড়িয়ে পড়া ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী। বারি গম-৩৩ নামের নতুন এই জাতটি একই সঙ্গে জিংক সমৃদ্ধও। দেশের গম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। সময়টিতে, বোরো মৌসুমের সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় ব্রি ধান-২৮’র পরিবর্তক নতুন একটি জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের নিরলস পরিশ্রমে উদ্ভাবিত ব্রি-৮১ নামের নতুন এই জাতটি সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় বীজ বোর্ড, যা প্রচলিত ব্রি-২৮’র চেয়েও আধা টন বেশি ফলন দেবে। কৃষিবিদরা মনে করেন, নতুন এই জাতটির প্রসার ঘটলে দেশে ঘটতে পারে ধান উৎপাদনে ‘নতুন আরেক বিপ্লব’। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের এসব সাফল্য দেশকে এগিয়ে নেবে বহুদূর।

নিউমোনিয়া চিকিৎসায় ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’

‘শ্যাম্পুর বোতলে পানি ঢুকালাম। বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে বাবল সিপিএপি তৈরি করা হলো। এটি খুবই সাধারণ প্রক্রিয়া। ভেন্টিলেটর পদ্ধতিতে দুটি নল ঢুকানো হলেও বাবল সিপিএপি ডিভাইসের মাধ্যমে কেবল একটি নল ঢুকানো হয়। অন্য আরেকটি নল দিয়ে বুদ্বুদ বের হয়। প্রথমে চার থেকে পাঁচটি বাচ্চার ওপর পরীক্ষা করলাম। দেখা গেল বুদ্বুদ বের হচ্ছে। এতে অক্সিজের খরচ যেমন কমছে তেমনি বেঁচে যাচ্ছে হাজার হাজার শিশুর প্রাণ।’Ñ কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন ড. মোঃ যোবায়ের চিশতী। দেশীয় এই চিকিৎসকের নতুন এই উদ্ভাবন বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নিউমোনিয়া চিকিৎসায় স্বল্প মূল্যের ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’ বৈশি^ক নীতি হিসেবে গ্রহণেও জোর আলোচনা চলছে। নিউমোনিয়া চিকিৎসায় বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মান (ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড) মেনে অক্সিজেন সরবরাহ হলেও শিশু মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তবে ড. চিশতীর উদ্ভাবিত নতুন এই পদ্ধতি বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ওই মানের চেয়েও ৭৫ শতাংশ অধিক শিশুর মৃত্যু রোধ করতে সক্ষম হয়েছে! ফলে উদ্ভাবিত পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে ইথিওপিয়া। বৈশি^ক নীতি হিসেবে গ্রহণের লক্ষ্যে পদ্ধতিটি নিয়ে শীঘ্রই গবেষণা শুরু হচ্ছে আফ্রিকাতেও।

আইসিডিডিআরবির ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বিভাগের প্রধান ডাঃ চিশতী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শিশুদের তীব্র নিউমোনিয়া হলে হাইপোক্সিয়া দেখা দেয়। রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে এটি হয়। তীব্র নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। একসময় অক্সিজেনকে সাপোর্টিং থেরাপি মনে করা হলেও বর্তমানে এটি ড্রাগ হিসেবে সমাদৃত। দেখা গেছে, নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড মেনে শিশুকে অক্সিজেন দেয়া হলেও মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ। যেহেতু আমাদের মতো হাসপাতালে ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড মানার পরও শিশু মারা যাচ্ছে, তাহলে অন্যান্য হাসপাতালে মৃত্যুর এই হার- তো অনেক বেশি! এটি আমাকে ভাবিয়ে তোলে।’ তিনি বলেন, ‘ভেন্টিলেটরের দাম ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার। সবাই ভেন্টিলেটর চালাতেও পারে না। এ জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্স দরকার আর কম খরচে নতুন উদ্ভাবনের চেষ্টাই আইসিডিডিআরবির লক্ষ্য। তবে চেষ্টা থাকে যেন একই চিকিৎসার খুব কাছাকাছি সেবা দেয়া যায় আর ভেন্টিলেটর দিয়ে সিপিএপি দেয়ার জন্য একটা নল ফুসফুসে ঢুকাতে হয়। সেটিও আবার সবাই ঢুকাতে পারে না। বিকল্প নিয়ে ভাবতে থাকি।’ আইসিডিডিআরবিতে নিজের রুমে বসে এক টানে বলে যাচ্ছিলেন। বলেন, ‘অস্ট্রিলিয়ার মেলবোর্নে কাজ করার সময় একটি বুদ্বুদ তৈরির সিপিএপি যন্ত্র দেখেছিলাম। সেটির কথা মনে পড়ে। তখন হাতের কাছে একটি শ্যাম্পুর বোতল ছিল। বোতলে পানি ঢুকালাম। বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে বাবল সিপিএপি তৈরি করা হলো। এটা খুবই সাধারণ প্রক্রিয়া। শিক্ষকরা পরে এটিকেই আমার গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করে দেয়। পিএইচডিতে আমাকে এর ওপরই গবেষণা করতে হয়েছে।’

জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে ড. মোঃ যোবায়ের চিশতী বলেন, ‘দেশে বাবল সিপিএপি পদ্ধতিতে অক্সিজেন দেয়ায় ৭৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে। যখন এই ডিভাইসটি নিয়ে কাজটি চলছিল তখন একই সঙ্গে ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড ও বাবল সিপিএপি পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এতে ওই ফল আসে। দেখা যায়, এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিশু মৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ কমে এসেছে। এখন আইসিডিডিআরবিতে সব শিশুকেই সিপিএপি পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে আফ্রিকাতেও এটা নিয়ে স্টাডি করা হবে। যদি একই ফল আসে তাহলে ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ডের পরিবর্তে এটাকেই গ্লোবাল পলিসি হিসেবে গ্রহণ করা হবে। ইথিওপিয়া সরকারও বাবল সিপিএপি পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশের গ্রামগঞ্জে এটি ছড়িয়ে দিতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। একটা বাবল সিক্যাপ তৈরি করতে মাত্র ১০০ টাকার মতো প্রয়োজন। আর অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দাম ৪০ হাজার টাকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভেনটিলেটর ব্যবহার করে অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে আইসিডিডিআরবির বাৎসরিক খরচ ছিল ৩০ হাজার ডলার। তবে বাবল সিপিএপি ব্যবহারের পর বার্ষিক ওই খরচ নেমে এসেছে মাত্র ৬ হাজার ডলারে।’

কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, ড. চিশতীর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। জন্ম ১৯৬৯ সালে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন কান্দিপাড়া আস্কর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এসএসসি ও এইচএসসিতে অসাধারণ কৃতিত্বের পর ভর্তি হন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। মেলর্বোনে উচ্চ শিক্ষা নিলেও ফিরে আসেন ঢাকায়। জানালেন, অস্ট্রেলিয়ায় তার সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর ট্রেভর ডিউক। চিশতীকে নানাভাবে তিনি অনুপ্রাণিত করছেন। তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু করার।

আইসিডিআিরবির একটি শিশু ওয়ার্ডে দেখা গেল, শ্যাম্পুর বোতলে তৈরি ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’তে অন্তত ৫ শিশুকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। অক্সিজেন কনস্ট্রেটর থেকে নল দিয়ে অক্সিজেন যাচ্ছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে দুটি নল নাকে সংযুক্ত করা হলেও এখানে একটি কেটে রাখা হয়েছে। একটি দিয়ে শ্যাম্পুর বোতলে বুদ্বুদ বের হচ্ছে। ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’তে শিশু যতটুকু শ^াস ছাড়ছে ততটাই বুদ্বুদ তৈরি হচ্ছে। ড. চিশতীর মতে, দেশের প্রতিটি হাসপাতালে সহজলভ্য এ পদ্ধতির প্রসার ঘটলে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় শিশু মৃত্যুর হার শূন্যতে নামিয়ে আনা সম্ভব।

ড. চিশতীর গবেষণার ফল প্রকাশ পায় বিশে^র প্রভাবশালী চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে। বিশ^ নিউমোনিয়া দিবস ২০১৫ তে সিপিএপি বাবল পদ্ধতি বেস্ট চাইল্ডহোড নিউমোনিয়া ইনোভেশন হিসেবেও স্বীকৃতি পায়। জানা গেছে, শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে ডাঃ চিশতীর কর্মজীবনের শুরু সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৯৬ সালে ওই হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে যখন তিনি কাজ করছিলেন, তখন প্রথম রাতেই তিনটি শিশুর মৃত্যু দেখতে পান। প্রথম দিনের ওই দেখা তাকে নাড়িয়ে তোলে। তখন থেকেই নিউমোনিয়া চিকিৎসায় কিছু একটা করার তেষ্টা পেয়ে বসে তাকে। তার ভাষায় ‘আই শুড ডু সামথিং’। ১৯৯৮ সালের মার্চে আইসিডিডিআরবিতে যোগ দেয়ার পর তার গবেষণা এগিয়ে যেতে থাকে। তবে এরই মধ্যে সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার। যেহেতু আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলেন তাই পিএইচডিতে এটিকে তিনি গবেষণার বিষয় হিসেবে নিতে চাননি। তবে শিক্ষকদের পরামর্শে তাকে নিউমোনিয়া নিয়েই গবেষণা করতে হয়। একই সঙ্গে আসে সর্বোচ্চ সফলতা। এখন তার উদ্ভাবিত ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’ নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন বৈশি^কভাবে।

ব্লাস্ট প্রতিরোধী ও জিংকসমৃদ্ধ বারি গম-৩৩

দেশে প্রথমবারের মতো ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন গম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। জাতটি একই সঙ্গে জিংকসমৃদ্ধও। বারি গম-৩৩ নামের গমের নতুন এই জাতটি আবাদের ফলে কৃষকের উৎপাদন যেমন বাড়াবে তেমনি তা যোগান দেবে জিংকেরও। শুধু তাই নয়, গমের ব্লাস্ট রোগ ছাড়াও নতুন এই জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধীও। এতে মাঠপর্যায়ে গম উৎপাদনে নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি জাতীয় বীজ বোর্ড গমের নতুন এ জাতটিকে অনুমোদন দেয়।

জানা গেছে, বিশে^র বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে গমে ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ দেখা দিলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষক। তখন মাঠের পর মাঠ গম ক্ষেত পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়। বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লাগে ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের নতুন জাত উদ্ভাবনে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন গম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা বারি-৩৩ নামের ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের এই জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়।

বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, দেশে ২০১৬ সালে গমে ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ দেখা দিলে ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গম গবেষণা কেন্দ্র এবং আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম গবেষণা উন্নয়ন কেন্দ্র (সিমিট) যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। ‘কেএসিএইচএউ’ এবং ‘এসওএলএএলএ’ জাতের মধ্যে সিমেট সংকরায়কৃত এ জাতটি হারভেস্ট প্লাস ট্রায়ালের মাধ্যমে ২০১৩ সালে দেশে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন আবহাওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভাল ফলন দেয়ায় বিএডব্লিউ ১২৬০ নামে জাতটিকে নির্বাচন করা হয়। জাতটি জিংকসমৃদ্ধ এবং দানায় জিংকের মাত্রা ৫০ থেকে ৫৫ পিপিএম। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সিমিটের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ-এআরএস ল্যাবরেটরিতে গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর কৃত্রিম সংক্রমণের মাধ্যমে পরীক্ষা করে জাতটি ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী হিসেবে প্রমাণিত হয়। এছাড়াও জাতটি যশোরের মাঠ পরীক্ষায়ও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী হিসেবে প্রমাণিত হয়। মাঠ পরীক্ষা ও গবেষণায় ইতিবাচক ফল আসায় সম্প্রতি নতুন এ জাতটিকে কৃষকের মাঠে আবাদের জন্য অনুমোদন দেয় জাতীয় বীজ বোর্ড।

জানা গেছে, বারি গম-৩৩’র জীবনকাল ১১০ থেকে ১১৫ দিন। এর শীষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৪২ থেকে ৪৭টি। দানার রং সাদা ও চকচকে এবং এটি আকারে মাঝারি। গমের ব্লাস্ট রোগ ছাড়াও জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান, জাতটি তাপসহিষ্ণু এবং এর কা- শক্ত হওয়ায় গাছ সহজে হেলে পড়ে না। উপযুক্ত পরিবেশে এ জাতের গমে ফলন হবে প্রতি হেক্টর ৪০০০ থেকে ৫০০০ কেজি।

গম গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ব্লাস্ট প্রতিরোধী ও জিংকসমৃদ্ধ বারি গম-৩৩ নামের নতুন জাতটি উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছি। বীজ বোর্ডের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ায় জাতটি যত দ্রুত কৃষকের মাঠে ছড়িয়ে দেয়া যাবে কৃষক ততই উপকৃত হবে। গম আবাদে মাঠ পর্যায়ে দ্রুত এ জাতের প্রসার ঘটলে গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তাই দ্রুত বীজ বর্ধনের মাধ্যমে জাতটি ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জাত উদ্ভাবন একটি চলমান প্রক্রিয়া। উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিমিট) সহায়তায় গমের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ বলেন, গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধী ও জিংকসমৃদ্ধ জাত বারি গম-৩৩ উদ্ভাবন আমাদের একটি বড় সাফল্য। তবে এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

মাঠ পর্যায়ে আসছে

ব্রি ধান ৮১

কৃষকের মাঠ পর্যায়ে আসছে আরও উচ্চফলশীল নতুন জাতের ধান। সবচেয়ে প্রচলিত ও মেগা প্রজাতির জাত ব্রি-২৮’র চেয়েও এর ফলন হবে বেশি। সদ্য অবমুক্ত হওয়া ব্রি ধান-৮১ নামের নতুন এই জাত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ ১৫ বছরের নিরলস পরিশ্রমে উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রি ধান-২৮ রোপণে হেক্টর প্রতি ৬ টন ফলন পাওয়া সম্ভব হলেও নতুন জাতের ব্রি-৮১’র ক্ষেত্রে উৎপাদন হবে সাড়ে ৬ টন করে। আর উপযুক্ত পরিচর্চা পেলে ফলন হতে পারে ৮ টনও। বোরো মৌসুমের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধান ব্রি ২৮’র পরিপূরক এই জাতটি রোপণ করা হলে এর গোছাগুলোও ঢলে পড়বে না সহজে। তবে সদ্য অবমুক্ত হওয়া এ জাতের মাঠ প্রদর্শনী শুরু করতে সময় লাগবে আরও ৩ বছর। আর ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক হারে পাওয়া যাবে ব্রি-৮১ ধানের বীজ। অধিক উৎপাদনে সক্ষম নতুন এই জাতে দীর্ঘমেয়াদী সময়ে দেশে ঘটতে যাচ্ছে ধান উৎপাদনের ‘নতুন আরেক বিপ্লব’।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ড. মোঃ শাহজাহান কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় ২৩ বছর পর আমরা ব্রি ধান-২৮’র পরিবর্তক জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছি। ১৯৯৪ সালে দেশে ব্রি-২৮’র জাত অবমুক্ত হয়। আর প্রায় ১৫ বছর গবেষণার পর একই ধরনের নতুন জাত ব্রি-৮১ উদ্ভাবন করেছি। এটি ব্রি-২৮’র চেয়ে ভাল হবে। এর চালে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ পোট্রিন রয়েছে, যা প্রচলিত যে কোন জাতের চেয়ে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, এর চাল চিকন এবং বিদেশে রফতানিযোগ্য। ফলে এ জাতের ধান উৎপাদনে কৃষক হবে অধিক লাভবান।

কৃষক পর্যায়ে নতুন জাতের এই বীজ কবে থেকে পাওয়া যাবেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সবে জাতটি অবমুক্ত হয়েছে। আমরা প্রথমে ৫০ কেজি ব্রিডার সিড পাব। ব্রিডার সিড থেকে পরের বছর ফাউন্ডেশন সিড করা হবে। তার পরের বছর হবে সার্টিফাইড সিড। তৃতীয় বছর কৃষক পর্যায়ে সীমিত আকারে ব্রি-৮১ ধানের বীজ বিতরণ করা সম্ভব হবে। জনপ্রিয়তা পেলে ৪র্থ বছরে আরও বেশি প্রদর্শনী করা হবে। অর্থাৎ ৪ থেকে ৫ বছর পর থেকে কৃষক পর্যায়ে নতুন এই জাতের বীজ ব্যাপক হারে পাওয়া যাবে।

নতুন উদ্ভাবিত ধানের জাত ব্রি ৮১ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তমাল লতা আদিত্য জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন জাতটি দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের গবেষণার পর উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রচলিত জাতগুলোর তুলনায় এর উৎপাদন যেমন বেশি হবে তেমনি এর চালও বিদেশে রফতানিযোগ্য। বাজারে এ চালের দাম হবে বেশি। ফলে কৃষকেরা অধিক লাভবান হবেন।

সম্প্রতি জাতীয় বীজ বোর্ড ব্রি ধান ৮১ নামের নতুন এ জাতের অনুমোদন দেয়। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ব্রি ধান ৮১ জনপ্রিয়তায় ব্রি ধান ২৮ এর স্থান দখল করবে। যার ফলে দেশের ধান উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে।

তথ্যমতে, নতুন উদ্ভাবিত জাতটির গড় ফলন হেক্টরে সাড়ে ৬ টন। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি হেক্টরে ৮ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার আমিষ, যার পরিমাণ শতকরা ১০ দশমিক ৩ ভাগ। ইরান থেকে সংগৃহীত জাত আমল-৩-এর সঙ্গে ব্রি ধান-২৮ এর সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাত ব্রি ধান-৮১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। ব্রি ধান-৮১ বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় ও মেগা জাত ব্রি ধান-২৮’র পরিপূরক একটি জাত। প্রতিকূল পরিবেশে এর গোছাগুলোও ঢলে পড়বে না। নতুন উদ্ভাবিত এই জাতটির জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। এ জাতের এক হাজার পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২০ দশমিক ৩ গ্রাম। ব্রি ধান-৮১ জাতে এ্যামাইলোজ রয়েছে শতকরা ২৬ দশমিক ৫ ভাগ এবং এতে উচ্চমাত্রায় আমিষ রয়েছে ১০ দশমিক ৩ ভাগ।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে ব্রি ধান-৮১ নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়। চলতি বছরে গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ের পুরো কাজ শেষ হয়। পরে বীজ বোর্ডে অনুমোদন চাইলে কৃষক পর্যায়ে এর অবমুক্তির সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। ১৫ বছর আগে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ইরান থেকে আমল-৩ জাতের ধান বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তখন থেকেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এই ধান থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী উচ্চ ফলনশীল ধান তৈরির কাজ করছিলেন। বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, ইরান থেকে সংগৃহীত জাত আমল-৩’র সঙ্গে ব্রি ধান-২৮’র সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাত ব্রি ধান-৮১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, এ নিয়ে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতের সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে ইনব্রিড জাতের সংখ্যা ৮০। বাকি ৬টি হাইব্রিড। দেশের ৮০ শতাংশের বেশি ধানি জমিতে এসব ধান চাষ হয় এবং এ থেকে আসে মোট ধান উৎপাদনের ৯১ শতাংশেরও বেশি।