কেউবা মাথায় করে, কেউবা প্যাকেটে আবার কেউবা বাইসাইকেলে করে সবজি আনছেন। শিম, বরবটি, বেগুন, কচু, ওল, পুইশাক, করলা, কাঁচাকলা, লাউ, কুমড়া, পাকাকলা, কচুর লতি, পেঁপে, লালশাক, কাকরোলসহ হরেক রকমের সবজি। উদ্দেশ্য বিষমুক্ত সবজির হাটের উদ্যোক্তা মনোয়ারা বেগমের কাছে বিক্রি করবেন। কারণ তার কাছে সবজি বিক্রি করলে বাজার থেকে কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেশি দাম পাবেন তারা। এই হাটের সবজি উৎপাদক অধিকাংশই গৃহিণী। বাড়ির প্রতিদিনের কাজের পাশাপাশি বাড়ির পাশে পতিত জমিতে একটি ইউনিয়নের ২টি গ্রামের প্রায় ৮০ জন গৃহিণীকে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের সহযোগিতা ও তাদের উৎপাদিত সবজি বাজারজাত করার কাজ করছেন মনোয়ারা বেগম নামের এক নারী। আর মনোয়ারা বেগমের বাড়িতে সপ্তাহের প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার এই হাট বসে। এই হাটে সবজি আনলে সব সবজি ক্রয় করে ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি নামের একটি বিষমুক্ত সবজির দোকানে পাঠিয়ে দেন তিনি।
পেশায় গৃহিণী মনোয়ারা একাধারে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের মেম্বার ও বিষমুক্ত সবজি, কম্পোস্ট ও জৈব বালাই নাশক উৎপাদক ও বাজারজাতকারী। মনোয়ারা বেগম কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তবাপুর গ্রামের আবদুুস সাত্তারের স্ত্রী। সামাজিক কার্যক্রমের কারণে তিনি খুলনা বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার, জাপানভিত্তিক হাঙ্গার ফ্রি প্রাইজ, এলজিইডি পুরস্কার পেয়েছেন।
অনুপমপুর গ্রামের বিষমুক্ত সবজি উৎপাদক মেহেরুন নেছা জানান, তাদের বাড়ির পাশে প্রায় ৭৫ শতাংশ জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করেন। এর মধ্যে লাউ, চাল কুমড়া, কচু, দুধকচু, পেঁপে, করলা, কাগুজে লেবু উৎপাদন করা হয়। আর এগুলো উৎপাদনের কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। জমিতে আমরা ভার্মি কম্পোস্ট সার আর জৈব বালাই নাশক ব্যবহার করি। প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমি মনোয়ারা বেগমের বাড়িতে সবজি নিয়ে যায়। তিনি বাজারের দামের চেয়ে কেজি প্রতি ৫ টাকা বেশি দরে কিনে নেন।
মোস্তবাপুর গ্রামের গৃহিণী রাবেয়া বেগম জানান, বাড়ির কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে তিনি বাড়ির পাশের পতিত জমিতে কলা, পুইশাক, লাশশাক, কচু চাষ করেছেন। আর তার এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, তার জমিতে কোনো রাসায়নিক সার তিনি ব্যবহার করেন না। উৎপাদিত সব সবজি মনোয়ারা বেগম তার কাছ থেকে কিনে নেন। রাবেয়া বলেন, সবজি চাষ করে আমার বাড়তি কিছু আয় হচ্ছে। যা দিয়ে সংসারে কাজে লাগাতে পারছি।
মোস্তবাপুর গ্রামের গৃহিণী রেকসোনা বেগম জানান, তার বাড়িতে পতিত জমি ছিল। একদিন তাকে সবজি উৎপাদনে উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, সব সবজি তিনি কিনে নেবেন। সেই থেকেই সব সবজি তিনি কিনে নেন। মনোয়ারা বেগম তার মতো গ্রামের প্রায় অধিকাংশ বাড়ির গৃহিণীদের সবজি চাষে উৎসাহ দেন। সবার উৎপাদিত সবজি তিনি কিনে নেন। রেকসোনা জানান, যাদের বাড়িতে কম্পোস্ট সার ও জৈব বালাইনাশক নেই তাদের বিনা মূল্যে এগুলো বিতরণ করেন মনোয়ারা বেগম।
সরেজমিন মনোয়ারা বেগমের বিষমুক্ত সবজির বাজারে গিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, নিয়ামতপুর ইউনিয়নে মোস্তবাপুর ও অনুপমপুর গ্রামের রাবেয়া, রেকসোনা, রাজিয়া, সাহিমা, সালেহা, মুসলিম, ডালিম, মেহেরুন, রাহেলা, শাহনাজ, জাহানারা, রেহেনাসহ প্রায় ৮০ জন গৃহিণীকে বাড়ির পাশে পতিত জমিতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করার জন্য পরামর্শ দিই। গৃহিণীদের বিভিন্ন সময়ে আমি বিনামূল্যে সবজির বীজ ও সবজি উৎপাদনের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব বালাইনাশক দিয়ে থাকি। তিনি গৃহিণীদের প্রতিশ্রুতি দেন তাদের বাড়িতে উৎপাদিত সব সবজি তিনি কিনে নেবেন। প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার বিকেল ৩টার দিকে গৃহিণীরা তাদের বাড়িতে উৎপাদিত সবজি নিয়ে আসেন এই হাটে। সবার সবজি তিনি কিনে নেন।
মনোয়ারা বেগম জানান, প্রচলিত বাজারের চেয়ে কেজি প্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেশি দামে এগুলো কিনে নেয়া হয়। মনোয়ারা বেগম জানান, কৃষকদের কাছ থেকে সবজি কিনে পিকআপ অথবা বাসযোগে তিনি ঢাকার প্রাকৃতিক কৃষি নামের একটি বিষমুক্ত সবজির দোকানে দেন।
তিনি বলেন, কালীগঞ্জের সেন্টার ফর অর্গানিক ফার্মের (সিওএফ) এসএম শাহিন হোসেনের কাছ থেকে তিনি বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। সেই সঙ্গে সেখান থেকে ভার্মি কম্পোস্ট ও বালাইনাশক তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। এখন নিজের বাড়িতে ১৫০টি চাড়ি ও ১৭টি কম্পোস্ট হাউজ রয়েছে। যেখান থেকে প্রতি মাসে ৩০ মণ কম্পোস্ট সার উৎপাদন করা হয়। যে সার নিজের জমিতে, যারা বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করতে চান তাদের বিনামূল্যে ও কিছু সার বিক্রি করে দেন।
মনোয়ারা বেগম বলেন, মানুষ এখন নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্যের কারণেই এই রোগগুলো হচ্ছে। সব সবজিতে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ বিষয়টি চিন্তা করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে এগিয়ে আসি। এখান থেকে তারা আমাকে কিছু লাভ দেন। তিনি জানান, আগামীতে নিয়ামতপুর ইউনিয়নের সব গ্রামে বাড়ির পাশে গৃহিনীণদের বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে তিনি সহযোগিতা করবেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার জাহিদুল করিম জানান, মনোয়ারা বেগমের বাড়িতে তিনি বেশ কয়েকবার গিয়েছেন। তার বিষমুক্ত সবজির বাজার তিনি দেখেছেন। তিনি বলেন, মনোয়ারা বেগম গৃহিণীদের কাছ থেকে সবজি কিনে ঢাকা শহরে পাঠাচ্ছেন-অবশ্যই এটি ভালো। তবে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কালীগঞ্জ শহরে একটি বিষমুক্ত সবজির দোকান করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর ফলে কালীগঞ্জের উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজি স্থানীয়রাও পাবেন।