৩ হাজার কোটি টাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শুরু নভেম্বরে

নগরীর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবদুচ ছালাম। তার দায়িত্ব পালনের সময় সাড়ে আট বছর পার হতে চলেছে। এ সময় নগরীর উন্নয়নে বাস্তবায়িত হয়েছে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। বাস্তবায়নের পথে রয়েছে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এসব প্রকল্পের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। নগরবাসীর আলোচনায় এখন সিডিএ এবং সিডিএর চেয়ারম্যান। আলোকিত বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সাইফুদ্দিন তুহিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন চলমান ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনার নানা দিক ।

আলোকিত বাংলাদেশ : এ মুহূর্তে নগরীর উন্নয়নে কি কি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে?

আবদুচ ছালাম : সিডিএর চেয়ারম্যান পদে ৫০ বছর পর রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে আমি নিয়োগ পেয়েছি। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন দায়িত্ব আমার কাঁধে নিলাম।’ তিনি কথা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী সিডিএর বহু প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। সেসব প্রকল্প একের পর বাস্তবায়ন হচ্ছে। ভবিষ্যতেও অনুমোদন হবে উন্নয়ন প্রকল্প। উন্নয়নের ধারা চলবেই। কখনও থামবে না। নগরীর আধুনিকায়নে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

আলোকিত বাংলাদেশ : জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পের অগ্রগতি কতটুকু?

আবদুচ ছালাম : নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের অনুমোদনও হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৩৬টি খাল আরএস শিট অনুযায়ী আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হবে। পাশাপাশি খালের উভয় পাশে ১৫ ফুট চওড়া সড়ক ও খালের মুখে পাঁচটি সøুইস গেট বসানো হবে। সিল্ট ট্র্যাপ ও জলাধার নির্মাণ এবং খাল খননের কাজ করবে সিডিএ। আর তা শেষ করতে হবে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে। খালগুলো হলো চাক্তাই খাল, বিরজা, রাজাখালী, চাক্তাই ডাইভারশন, মির্জা, হিজরা, চট্টেশ্বরী, জামালখান, বদরখালী, ফিরিঙ্গিবাজার খাল-বারমাসিয়াখাল-ফিরিঙ্গিবাজার খাল-২, শীতল ঝরনা, বামনশাহী, নোয়াখাল, ত্রিপুরা, মহেশ, নয়ারহাট, নাসির, কালাবাগিচা, মরিয়ম বিবি, মোগলটুলি, গুপ্তা, রুবি সিমেন্ট, উত্তরা, খন্দকিয়া, ডোমখালী, টেকপাড়া, রামপুর, পাকিজা, আজব বাহার, গয়না ছড়া, পতেঙ্গা নিজাম মার্কেট, ১৫ নম্বর ঘাট বিমানবন্দর, সদরঘাট ১ ও সদরঘাট ২ নম্বর খাল। প্রকল্পের আওতায় এ ৩৬ খাল থেকে খননের মাধ্যমে ৫ লাখ ২৮ হাজার ২১৪ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হবে। একই সঙ্গে ৪২ লাখ ঘনমিটার কাদা অপসারণ করা হবে। নতুন করে ড্রেন নির্মাণ করা হবে ১০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। ১ লাখ ৭৬ হাজার মিটার দীর্ঘ রিটেনিং দেয়াল নির্মাণ করা হবে। খালের উভয় পাশে ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মিত হবে। নগরীর ৩৬ খালের পানি ধারণ করে রাখার জন্য এবং ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের জন্য তিন অংশে তিনটি জলাধার নির্মাণ করা হবে। ‘চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও পাথরঘাটা এলাকার রাজাখালি খাল, মরিয়মবিবি খালগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে একটি জলাধার হবে। এছাড়া মহেশখালের অংশে একটি ও মোহরা এলাকার খালগুলো সমন্বয় করে একটি জলাধার গড়ে তোলা হবে। খালের ভেতরে প্রায় এক একর ব্যাস আয়তনের একটি জলাধার নির্মাণ করা হবে। খালের এলাইনমেন্টের জায়গায় থাকবে এসব জলাধার।
আলোকিত বাংলাদেশ : প্রস্তাবিত লালখান বাজার-বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের কি অবস্থা?
আবদুচ ছালাম : ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে লালখানবাজার-বিমানবন্দর ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শিগগির শুরু হবে। এটি সিডিএর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাজেটের প্রকল্প। লালখানবাজার-বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের সঙ্গে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার যুক্ত হলে যার নাম হবে ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’। এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। প্রায় ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ ফ্লাইওভারে থাকছে ২৪টি র‌্যাম্প, ১৬টি জংশন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ তাদের সার্ভে শেষ করেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে শুরু হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ আবার প্রাণ ফিরে পাবে। কারণ বিমানবন্দর থেকে শিল্পাঞ্চল কালুরঘাট, ফৌজদারহাট, নাসিরাবাদ যেতে সময় লেগে যায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম থেকে ৪০ শতাংশ যে এক্সপোর্ট ছিল, তা কমতে কমতে এখন ইপিজেডসহ ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর একমাত্র কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে প্লেনে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। ব্যাংকক থেকে আসতে লাগে পৌনে ২ ঘণ্টা। বিমানবন্দর থেকে নাসিরাবাদ, ফৌজদারহাট আসতে সময়ে লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হলে দ্রুততার সঙ্গে নগরীর অভ্যন্তরে যোগাযোগ বাড়বে।
আলোকিত বাংলাদেশ : পাঁচ বছরে কর্ণফুলীর পাড় থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেগা প্রকল্পে কি কি করা হবে?
আবদুচ ছালাম : কর্ণফুলীর পাড় থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৫ বছরের মধ্যে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। বিশাল সম্ভাবনার ইকোনমিক জোন, শিল্প পার্ক, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটনশিল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর, এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্প দিয়ে সাজানো হচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে। ৫ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্ষমতা, ধারণক্ষমতা, দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বন্দর আধুনিকায়ন হবে। সব কিছুতে গতি আসছে। এক্সপ্রেসওয়েটি দক্ষিণ চট্টগ্রামকে বিমানবন্দর এবং বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে। শাহ আমানত ব্রিজ থেকে শুরু হয়ে বাকলিয়া-বহদ্দারহাট পর্যন্ত রোডের কাজ চলছে। বহদ্দারহাট জংশনের র‌্যাম্প নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের কাজ বহু আগেই শেষ করা আছে। মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ। চলছে যানবাহন। লালখানবাজার থেকে ফ্লাইওভারটি যখন বন্দরের পাশ দিয়ে বিমানবন্দর চলে আসবে, তখন বিশাল সম্ভাবনার দক্ষিণ চট্টগ্রামকে বাস্তবায়ন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এক্সপ্রেসওয়েটি।
আলোকিত বাংলাদেশ : কালুরঘাট রিং রোড কবে শেষ হবে?
আবদুচ ছালাম : কালুরঘাট থেকে চাক্তাই খাল বেড়িবাঁধ কাম আউটার রিং রোড, ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার টাকার প্রকল্প। কর্ণফুলীর কোলঘেঁষে সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ প্রকল্পে চার লেনের সড়ক হচ্ছে, যা শহরের আউটার রিং রোডেরও অংশ। সাড়ে ৮ কিলোমিটার সড়কের ১৩৮ পয়েন্টে মাটি পরীক্ষার (সয়েল টেস্ট) কাজ শেষ। ১২ খালের মুখে সয়েল টেস্টের কাজ শেষ। বেড়িবাঁধ কাম আউটার রিং রোডের ডিজাইনের কাজ শেষ। এ পর্যন্ত প্রকল্পের অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেছে। শিগগির পুরো কাজ শেষ হবে। রিং রোড হলে কর্ণফুলীকে ঘিরে পর্যটন শিল্প উন্নতি করবে। এছাড়া আবাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য দেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যাবে। আগ্রাবাদ, নিউমার্কেট ও কোতোয়ালি এলাকার যানবাহনগুলো শহরের ভেতরের সড়কগুলো ব্যবহার না করে কর্ণফুলীর তীরবর্তী এ সড়ক দিয়ে অল্প সময়ে নগরীর উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিকে যাতায়াত করতে পারবে। শহরের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অংশ ও কাপ্তাই থেকে আসা যানবাহন শহরের প্রধান সড়কগুলো বাইপাস করে শাহ আমানত সেতু ব্যবহার করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী ও কক্সবাজারে দ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে। একইভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যানবাহনগুলো শহরের উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিক এবং কাপ্তাই অভিমুখে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে।
আলোকিত বাংলাদেশ : পতেঙ্গা বিচ এলাকাকে সমৃদ্ধ করে প্রতিদিন ১০ হাজার পর্যটকের সমাগম হবেÑ এ প্রকল্পটি কি?
আবদুচ ছালাম : এক্সপ্রেসওয়ের প্রভাব পড়বে চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পে। চট্টগ্রাম নগরীর পর্যটন ক্ষেত্র পরিণত হবে আন্তর্জাতিক মানে। পতেঙ্গা এলাকায় ১০ হাজার পর্যটক প্রতিদিন ঘুরতে পারবেন। এটি এশিয়ার অন্যতম পর্যটন স্পটে পরিণত হবে।
আলোকিত বাংলাদেশ : ফ্লাইওভারের কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছেÑ এ অভিযোগের সত্যতা কতটুকু?
আবদুচ ছালাম : ফ্লাইওভারসহ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নগরীতে জলাবদ্ধতা কিংবা সংকট সৃষ্টির কথা অপপ্রচার। জলাবদ্ধতার সঙ্গে ফ্লাইওভারের কোনো সম্পর্ক নেই। ফ্লাইওভার নির্মাণের আগে বর্ষায় জলাবদ্ধতা হতো। ফ্লাইওভার নির্মাণের পরেও হচ্ছে। এটার সঙ্গে সিডিএর উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই।
আলোকিত বাংলাদেশ : আবাসিক সংকট নিরসনে নতুন প্রকল্প কবে বাস্তবায়ন হবে?
আবদুচ ছালাম : সিডিএর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আবাসন সংকট নিরসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন সময়ে প্লট বরাদ্দ করে আবাসন সংকট নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। এবার তিন হাজার প্লটসমৃদ্ধ সিডিএর আবাসিক প্রকল্প অনন্যা-২ বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। ডিসেম্বর নাগাদ প্লটের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হবে। এটি হবে আধুনিক একটি উপশহর। সিডিএর উদ্যোগে এটি হবে মাইলফলক একটি প্রকল্প।
আলোকিত বাংলাদেশ : উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নগরবাসীসহ বিভিন্ন সংস্থার কি ধরনের সহায়তা প্রত্যাশা করেন?
আবদুচ ছালাম : উন্নয়ন কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিতভাবে সবার সহযোগিতা দরকার। আমি চাই সবার সহযোগিতায় চট্টগ্রাম নগরীকে একটি সমৃদ্ধ আধুনিক নগরীতে পরিণত করতে। এ লক্ষ্যে আমি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করি আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হব।