এমন মানুষদের জন্যই এখনো স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ

পত্রিকার পাতা খুললেই আজকাল চোখে পড়ে শুধু খারাপ খবর।

চারিদিকে খুন-ধর্ষণ-ছিনতাই অহরহ হচ্ছেই, সাম্প্রদায়িক হামলা তো এখন ডালভাত আর রাস্তার এমন অবস্থা যে একবার বাসা থেকে বের হলেই জীবিত ফিরব কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ঘরেও যে খুব নিরাপদে আছি তেমন নয় কিন্তু, কখন যে কে এসে হানা দিবে এবং প্রাণ নিয়ে চলে যাবে তা শুধু উপরওয়ালাই জানেন।

বাংলাদেশ জঙ্গি দেশ, বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম ২০ দেশের একটি, এ দেশে ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না, বাংলাদেশ বসবাসযোগ্য দেশ হিসেবে অনেক নিচে অবস্থান করছে, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহর- এসব শুনতে শুনতে আমরা অনেক ক্লান্ত।
কিন্তু এত খারাপ খবরের ভিড়েও কিছু মানুষ আমাদের জন্য ভালো খবর নিয়ে আসেন, যা বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের বুক গর্বে ভরিয়ে দেয়। মনে হয় যে নাহ, এখনো আশা আছে এই দেশটাকে নিয়ে।

তেমনি একজন হচ্ছেন ডাক্তার মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী। পত্র-পত্রিকার কল্যাণে ইতিমধ্যেই হয়তো জেনে ফেলেছেন এই মানুষটি আর তার কীর্তির কথা।

১৯৮৪ সালে তেজগাঁও পলিটেকনিক সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণী নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন এই কৃতি গবেষক। উচ্চমাধ্যমিকে নটরডেম কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে এইচএসসি পাস করে তিনি ভর্তি হন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে ভালো ফলাফল নিয়ে ১৯৯৫ সালে পাস করেন ব্যাচেলর অফ মেডিসিন এবং ব্যাচেলর অফ সার্জারি কোর্স (এমবিবিএস)।

এমবিবিএস শেষ করার পরপরই মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নশিপ করার সময় এক ঘটনা তার মনে দাগ কাটে।
ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে তার প্রথম নাইট ডিউটি ছিল সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে। নানা রোগে আক্রান্ত শিশুরা সেই ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল, তাদের চিকিৎসার তদারকি করছিলেন ইন্টার্ন জোবায়ের। কিন্তু সেখানে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত তিনটি শিশুকে অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি তিনি।

এই ব্যর্থতার কষ্টে চোখে পানি এসে গেলেও, হাল না ছেড়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্য জীবনে কিছু একটা করবেন। এই লক্ষ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ডক্টর জোবায়ের রিসার্চ ফেলো হিসেবে বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি’তে কাজ করেন সিনিয়র রিসার্চারদের তত্ত্বাবধানে।

২০০০ সালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগ দেন আইসিডিডিআর,বি’তে। সেখানে তার দায়িত্ব ছিল নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর গবেষণা তত্ত্বাবধান করাঃ

  • ৩ থেকে ৩২ মাস বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়ার ইমিউনোলজিক্যাল রিস্ক ফ্যাক্টর বের করা,
  • শিগেলোসিসে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় জিংক সাপ্লিমেন্টের ব্যাবহার এবং
  • ভিব্রিও জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত রোগীদের ইমিউন রেস্পন্স দেখা।

পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে তিনি সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন ঢাকা হাসপাতালে। গবেষক, শিক্ষক এবং ট্রেনার হিসেবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বি’তে কাজ করেন তিনি। কাজের উপর উচ্চতর গবেষণার লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নে মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে যান ২০০৯ সালে। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পেয়ে, পরে রয়্যাল চিলড্রেন হসপিটালে পেডিয়াট্রিক রেসপাইরেটরি মেডিসিনে পিএচডি ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। নিজের ইচ্ছা আর প্রচেষ্টায় পিএইচডি কোর্সে ডক্টর জোবায়ের এমনই কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করেন যে, তার পিএইচডি এক্সামিনার বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাপূর্ণ চ্যান্সেলর পুরস্কারের জন্য তার নাম রেকমেন্ড করেন।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ গবেষণা পত্রিকায় তার অসংখ্য বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ আছে লেখক এবং সহকারী লেখক হিসেবে। এমন ভালো ফলাফলের পরে ডক্টর জোবায়ের যদি চাইতেন, তবে অনেকের মতই বিদেশে রয়ে যেতে পারতেন। বিনিময়ে পেতেন অঢেল অর্থ, খ্যাতি এবং উন্নত জীবনযাপনের সবরকম সুবিধা। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন, যারা শত সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে এই বাংলাদেশের টানেই ছুটে চলে আসেন বিদেশ থেকে। ডক্টর জোবায়েরও তেমনই এক দেশপাগল মানুষ।
দেশে এসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন, শুরু করেন নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি সুলভ সিপিএপি যন্ত্র উদ্ভাবনের কাজ।

নিউমোনিয়ার গুরুত্ব কি?

সারা বিশ্বে শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়া অন্যতম। সদ্যজাত শিশু থেকে আরম্ভ করে কয়েকবছর বয়সী শিশুসহ প্রতি বছর প্রায় ৯ লক্ষ ২০ হাজার শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়। সব জায়গার শিশুরা আক্রান্ত হলেও অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যাবস্থাসহ অপুষ্টি এবং অন্যান্য কারণে প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর হার বেশি।

নিউমোনিয়া রোগের কারণ এবং লক্ষণঃ

স্ট্রেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া কিংবা শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) সংক্রমণ এর কারণেই নিউমোনিয়া রোগ হয়ে থাকে। নিউমোনিয়া রোগে জীবাণু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুইভাবেই সংক্রমণ ঘটায়। একদিকে জীবাণুরা নানারকম দূষিত পদার্থ নিঃসরণ করে ফুসফুসের কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয়, অপরদিকে পরোক্ষভাবে কোষগুলোর অক্সিজেন ডেলিভারি এবং বর্জ্য পদার্থ দূর করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলে ফুসফুসের কোষগুলো ভরে ওঠে পুঁজে বা তরল পদার্থে, এবং অক্সিজেন গ্রহণ করার পরিমাণ কমে যাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। এতে বাচ্চা জ্বরসহ অন্যান্য লক্ষণ ছাড়াও ভয়াবহ শ্বাসকষ্টে ভোগে।

নিউমোনিয়ার ব্যয়বহুল চিকিৎসাঃ

ওষুধ দিয়ে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করা হলেও, শ্বাসকষ্টের জন্য বাচ্চাদের কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করানো অত্যন্ত জরুরি এবং প্রয়োজনীয়। বিদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস দেওয়া হয়। নিউমোনিয়া হলে ফুসফুসে ঠিকভাবে বাতাস পৌঁছায় না, কারণ এই রোগে ফুসফুসের কোষগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন ভেন্টিলেটর বা সিপিএপি যন্ত্র দিয়ে ফুসফুসে নিয়মিত বায়ুর যোগান দিয়ে পসিটিভ প্রেসার তৈরি করা হয়। এতে ফুসফুস কাজ করা থামায়না এবং শরীরেও পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছায়। ফলে রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ।

কিন্তু ১৫ হাজার ডলার (প্রায় ১২ লাখ টাকা) দামের যন্ত্রগুলি আমাদের মত দেশের সাধারণ মানুষদের হাতের নাগালের বাইরে। এছাড়া এই যন্ত্র চালাতে লাগবে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান।

অল্প দামে অনেক কাজঃ

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে কাজ করার সময় ড. জোবায়ের ল্যাবে একটি বাবল তৈরির সিপিএপি যন্ত্র দেখেছিলেন, তাই তিনি চিন্তা করলেন যে এমন একটি সিপিএপি যন্ত্র বানাবেন যা দামে কম হবে কিন্তু ভালো কাজ করবে। কিন্তু কিভাবে সেটি সম্ভব হবে? তার এমন বুদবুদ যন্ত্র আবিষ্কার করতে হবে, যা ফুসফুসের দুর্বল কোষগুলোতে পজিটিভ প্রেশার দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখবে। একদিন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ফেলে দেওয়া একটি প্লাস্টিকের শ্যাম্পু বোতল নিয়ে সহকর্মীর সাথে কাজ করার সময় তিনি আশার আলো দেখতে পান।

“বাচ্চারা অক্সিজেন টেনে নেবে একটি জলাধার বা ওয়াটার রিজার্ভয়ার থেকে এবং নিঃশ্বাস ছাড়বে একটি টিউবের মাধ্যমে যা ডোবানো থাকে একটি পানির বোতলের মধ্যে, যার ফলে বাতাসে বুদবুদ সৃষ্টি হয়। বুদবুদ থেকে সৃষ্ট চাপ ফুসফুসের মধ্যে ছোট বায়ুথলি গুলিকে খুলে রাখতে সাহায্য করে। ফলে বাচ্চার শ্বাসকষ্টের সমস্যার সমাধান হবে”- এটাই ছিল তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের মুলনীতি।

নিশ্চিত হতে দুই বছরের পর্যবেক্ষণঃ

নিজের এই যন্ত্র প্রথমে কয়েকজন শিশুর উপর প্রয়োগ করে তিনি ভালো ফলাফল পান। পরবর্তীতে প্রায় ৬০০ শিশুর উপর এই কমদামী বাবল সিপিএপি যন্ত্রটি ব্যাবহার করা হয় এবং সবখানেই পজিটিভ রেজাল্ট আসে।
এরপর দুই বছর পর্যবেক্ষণ করে তিনি বিখ্যাত দ্য ল্যান্সেট পত্রিকায় তার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন।সেখানে বাজারে প্রচলিত দামী সিপিএপি যন্ত্রের চেয়ে এই যন্ত্রের তুলনামূলক বর্ণনায় ডক্টর বলেন,

  • এই যন্ত্রটি ব্যাবহারে খরচ মাত্র ১.২৫ ডলার বা ১পাউন্ড। (প্রায়১০০টাকা)
  • এই যন্ত্রের ব্যাবহারে অক্সিজেন অনেক কম পরিমাণ লাগে, ফলে অক্সিজেনের খরচের জন্য পাঁচ ভাগের এক ভাগ টাকা লাগে।
  • যন্ত্রটির ব্যবহারে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ৭৫ শতাংশ কমেছে।

ব্যাক্তিগত সম্মাননাঃ

ডক্টর জোবায়েরের ব্যাক্তিগত সম্মাননার তালিকা দীর্ঘ। এদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছেঃ

  • ২০১২ সালে “রিসার্চ এবং ইনোভেশন” এর জন্য অস্ট্রেলিয়ান সরকার কর্তৃক এলামনাই এক্সিলেন্স পুরস্কার।
  • ২০১৪ সালে পিএইচডি থিসিসে অসামান্যতার জন্য তিনি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে চ্যান্সেলর পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
  • ২০১৫’তে গ্লোবাল নিউমোনিয়া ইনোভেশন টিম দ্বারা তার কাজকে শিশু নিউমোনিয়া প্রতিকারে সেরা দশটি আবিষ্কারের অন্যতম বলে পুরস্কৃত করা হয়।

সবার জন্য চিকিৎসাঃ

এত দায়িত্ব এবং খ্যাতির পরেও তিনি যেন আগের সেই ইন্টার্ন চিকিৎসকই রয়ে গিয়েছেন। তাইতো, এখনো শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও নিজের তিন সন্তানকে যেভাবে সময় দেন, সেভাবে শিশু ওয়ার্ডের বাচ্চাদের সাথে সময় কাটান। বিশ বছর আগে করা নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পেরে কোথায় একটু বিশ্রাম নিবেন তা না, তিনি এখন চেষ্টা করছেন কিভাবে এই যন্ত্রকে সবখানে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

বিনয়ী এই মানুষটি স্বপ্ন দেখেন এমন একটি দিনের যখন “নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য হয়ে যাবে”।

ডক্টর জোবায়ের চিশতীর সাথে সাথে আমরাও আশায় রইলাম এমন একটি দিনের।

তথ্যসূত্রঃ

১। রিসার্চগেট

২। আইসিডিডিআর, বি

৩। মার্ক ম্যানুয়ালস

৪। বিবিসি বাংলা