দারিদ্র্য কমছে

২০১৬ সাল শেষে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ দরিদ্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে (এইচআইইএস) দারিদ্র্য পরিস্থিতির এ চিত্র পাওয়া গেছে। এর আগে ২০১০ সালে এ জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস। তখন দেশের জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। ছয় বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। মোট দারিদ্র্যের পাশাপাশি অতি দারিদ্র্যের হারও আগের তুলনায় কমেছে। সর্বশেষ জরিপে অতি দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালের জরিপে ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ।

নতুন জরিপের এ ফল বিশ্নেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের তুলনায় সর্বশেষ ছয় বছরে (২০১১-২০১৬) দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমেছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া,
দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়া, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং বৈষম্য বেড়ে যাওয়া এর কারণ বলে তারা মনে করেন।

২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত এক বছর ধরে বিবিএস দেশব্যাপী সর্বশেষ জরিপটি পরিচালনা করে। এতে ৪৬ হাজার ৮০টি পরিবারের আয়-ব্যয়ের তথ্য নেওয়া হয়। খানা আয় ব্যয় জরিপে এটাই সবচেয়ে বড় নমুনা। আজ ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জরিপের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবেন।

১৯৯২ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ১৭ অক্টোবরকে দারিদ্র্য বিমোচন দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘দারিদ্র্য নিরসনে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের পথে’। গত বছর এই দিনে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য দেখতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ঢাকায় এসেছিলেন।

১৯৯৫ সালের পর থেকে পাঁচ বছর পর পর এ জরিপ করে আসছে বিবিএস। ২০১০ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপরে কোনো জরিপ না হলেও ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আগের জরিপের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সে প্রক্ষেপণেও কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশের দারিদ্র্য হার কমেছে। ২০১১ সালে ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২৬ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ দারিদ্র্যের হার প্রাক্কলন করা হয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে। ওই সময়ে চরম দারিদ্র্য হার ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছে সরকার।

বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশে ১১ লাখ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হারে ভাটা পড়েছে। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩ দশমিক ১ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বেড়েছে। আর ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বেড়েছে। কর্মসংস্থান দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম হাতিয়ার।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের ধারা ঠিক আছে, তবে গতি কমেছে। কারণ, ২০০৫ সালের জরিপের সঙ্গে ২০১০ সালের জরিপে ৫ বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্য কমেছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এবার ছয় বছরে দারিদ্র্য কমেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ, শেষ কয়েক বছরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমে গেছে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্রদের যেভাবে মজুরি বাড়ে, সেরকমভাবে তা বাড়েনি। আবার রেমিট্যান্স কমেছে। বেড়েছে বৈষম্য। এ ছাড়া সরকার যেসব জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিচ্ছে তার সুফল সবার কাছে ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না।

তবে দারিদ্র্য বিমোচনে রাষ্ট্রের ফোকাল পয়েন্ট পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জন দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। প্রতি এক দশকে দেশের প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ করে বেড়েছে। বর্তমানে ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে গতিশীলতার কারণে মজুরি বেড়েছে। বাজেটের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনকে সামনে রেখে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের ৫৪ দশমিক ২০ শতাংশ বা ২ লাখ ১৬ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকার ব্যয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য বিমোচনকে কেন্দ্র করে ধরা হয়েছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সরাসরি দারিদ্র্য মোকাবেলা করে মানুষের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। সরকারও এ খাতে ব্যয় প্রতি বছর বাড়াচ্ছে। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৫৪ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ১৩৬ ধরনের কর্মকান্ড রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩৩টি কর্মসূচি চলমান ছিল। ২০১৬ সালে দেশের মোট জনগণের ২৭ দশমিক ৮০ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করেছে।

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ৮২ শতাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র। এখন এ হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্যান্য দেশকে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছে। গোটা বিশ্বে দারিদ্র্য যে হারে কমেছে বাংলাদেশে কমেছে তার চেয়ে বেশি হারে।

বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অনুযায়ী ওই হার ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ তিন বছর আগেই ২০১২ সালে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ অতি দারিদ্র্য বিদায় করতে চায় বাংলাদেশ।

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি সমকালকে বলেন, নিঃসন্দেহে দারিদ্র্য কমছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে অভ্যন্তরীণ উৎপানশীলতা এবং রেমিট্যান্স। পাশাপাশি শহর থেকে অনেক অর্থ এখন গ্রামে যাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাব ফেলছে। সরকারকে সময়মতো এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে।