দৃষ্টিহীন নয়নের অন্ধত্ব জয়

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত্ম গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর শহরের বিভিন্ন হাটবাজারে সেই মালামাল ফেরি করে বিক্রি করেন নয়ন মিয়া। যা উপার্জন হয় তা দিয়েই চলে নয়নের পাঁচ সদস্যের পরিবার। শুধু নিজের জীবন নয়, মা ও একমাত্র বোনের জীবন-জীবিকার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নয়ন মিয়া। অনেক কষ্ট হয় তবু তিনি ভিক্ষা করেন না, ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা করেন।

নয়নের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার বানারি গ্রামে। তার বাবা মৃত আব্দুল জলিল ছিলেন দিনমজুর। মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ভিটেমাটি হারিয়ে তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরে চলে আসেন। বর্তমানে তিনি শ্রীপুর পৌর এলাকার পিয়ার আলী কলেজ সংলগ্ন শাহিনের বাড়িতে বসবাস করেন। এরই মধ্যে পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছেন। সাড়ে তিন বছরের হামিম নামে এক ছেলে সন্ত্মানও রয়েছে তার।
২৫ বছর বয়সী নয়ন জানান, আড়াই বছর বয়সে তার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। দরিদ্র বাবার পক্ষে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। কিছু বুঝে উঠার আগেই হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। এরই মাঝে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা মারা যান। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে ভাইয়েরা যে যার মতো আলাদা হয়ে যান। মা ও একমাত্র বোনের দায়িত্ব নেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নয়ন মিয়া। ভিটেমাটি না থাকায় বৃদ্ধ মা ও বোনকে নিয়ে চলে আসেন গাজীপুরের শ্রীপুরে।
১০ বছর আগের কথা। শ্রীপুরে এসে জীবিকা অর্জনের কোনো পথ না পেয়ে বিভিন্ন লোকজনের পরামর্শে শুরম্ন করেছিলেন ভিক্ষা। দিনে যা আয় হতো তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলছিল তার। তবে বিয়ে ও সন্ত্মান জন্মের পর তার মাথায় নতুন চিন্ত্মা ভর করে। নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতার জন্য আড়াই বছর যাবৎ ছেড়ে দেন ভিক্ষাবৃত্তি। এরই মাধ্যমে জমানো পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরম্ন করেন ব্যবসা।
ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়ার বিষয়ে নয়ন জানান, ‘অন্যের হাতের দিকে চেয়ে একজন মানুষ বাঁচতে পারে না। কারণ, প্রত্যেকটা মানুষের মনুষ্যত্ব ও বিবেক রয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা ও বোনকে নিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। কয়েকদিন না খেয়েও থাকতে হয়েছে। অন্যের বাড়িতে কাজের জন্য শ্রীপুরে এসেছিলাম। আমি অন্ধ বলে কেউ আমাকে কাজ দেয়নি। শুধু ক্ষুধার জ্বালায় আমি ভিক্ষাবৃত্তি শুরম্ন করি ইচ্ছার বিরম্নদ্ধে। হাতে সামান্য পুঁজি ও শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা আমার পরিচিত হওয়া মাত্রই আমি ভিক্ষা ছেড়ে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসার সিদ্ধান্ত্ম নেই। এখন শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা আমার পরিচিত হয়ে গেছে। অন্যের সাহায্য ছাড়াই চলতে পারি। ব্যবসার আয় সামান্য হওয়া সত্ত্বেও আমি পুরো পরিবার নিয়ে সুখে আছি।’
নয়নের আশা ভবিষ্যতে যদি সামান্য ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা হতো তাহলে এ ব্যবসা ছেড়ে দোকান দিতেন। অনেকটা দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে ব্যবসার জন্য বের হতে হয়।
শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মঞ্জুরম্নল হক জানান, সরকার ভিক্ষাবৃত্তি নিরম্নৎসাহিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। নয়ন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হতদরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় তারাও পারে। তবে নয়নকে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা হবে।