আসুন, সবাই সাজেদাকে অনুসরণ করি

গ্রামের একটি সাদাসিধে মেয়ে। অথচ বুকে কী প্রচণ্ড সাহস। একটা নয়, দুটা নয়, ১০৭টি মেয়ের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে সে! ভাবা যায়? সাহসী এই মেয়ের নাম সাজেদা আক্তার। গতকাল শনিবার প্রথম আলোয় সাজেদার এই সাহসী কর্মকাণ্ডের কথা ছাপা হয়।

বরগুনার সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের মাইঠা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সাজেদা আক্তার এখন বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। বয়স এখনো ১৮ পেরোয়নি। অথচ এই বয়সে সে অসম সাহসিকতার সঙ্গে যেভাবে একের পর এক বাল্যবিবাহ রোধ করে চলেছে, সে জন্য তাকে লাখোবার স্যালুট।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ রোধে এই অনবদ্য ভূমিকা রাখার জন্য সাজেদাকে এ বছর ‘ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজ’-এর জন্য বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেব মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সত্যিই সাজেদার জন্য গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে।

আমাদের মতো দেশে ১০৭টি বাল্যবিবাহ রোধ করা মুখের কথা নয়। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের কাজ করা কত কঠিন, তা সবাই জানেন। সাজেদাকেও অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু সাজেদা সব বাধা অতিক্রম করে একের পর এক বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে চলেছে। বলা চলে, যে মেয়েগুলোর বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে, তাদের নতুন করে জীবন দিয়েছে। অল্প বয়সে বিয়ের কারণে এই মেয়েগুলোর যা যা হতো, সেগুলো হচ্ছে, প্রথমে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত, তারপর অল্প বয়সে গর্ভধারণ করত, এরপর সন্তান জন্মদানের সময় তারা নানা রকম শারীরিক জটিলতার মধ্যে পড়ত, এদের একটি অংশ অকালে মারা যেত। ভাগ্যক্রমে কেউ বেঁচে গেলেও অপুষ্ট বা অপরিণত শিশুর জন্ম দিত, নিজেও ভুগত অপুষ্টিতে। ফলাফল একটি অশান্তিময় জীবন।

বাংলাদেশ যে কয়টা সমস্যায় জর্জরিত, বাল্যবিবাহ তার মধ্যে একটি। এটা একটা বড় সামাজিক সমস্যা। বাল্যবিবাহ রোধে সরকার আইন প্রণয়নসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে (যদিও আইনের একটি ধারা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করে চলেছে। কিন্তু তারপরও দেশে বাল্যবিবাহ হয়েই চলেছে। আসল সমস্যা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন নয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং শহরের বস্তি এলাকায় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিলে তার ক্ষতি করা হয়—এই সত্য অনেক মা-বাবা উপলব্ধি করতে পারেন না। দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক বাবা-মা কিশোরী মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে স্বামীর বাড়ি পাঠাতে চান। তাঁরা ভাবেন, এর ফলে মেয়ের ভরণপোষণের ব্যয়ভার থেকে তাঁদের মুক্তি মিলবে। আবার বখাটেদের উপদ্রবের কথা ভেবে অনেক মা-বাবা দ্রুতই মেয়ের বিয়ে দেন।

এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ভিত্তিতে সচেতনতা সৃষ্টি করা, যেটা কিনা সাজেদা করে চলেছে। কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছে। মেয়েদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিয়ে বন্ধ করছে। সাজেদা শুধু যে বাল্যবিবাহ বন্ধ করছে তা নয়, ইভ টিজিং ও মাদকের বিরুদ্ধেও সে জনসচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজ করে চলেছে। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনছে। এলাকার কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য হিসেবে সে এসব করে চলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামের একজন কিশোরী হয়ে সাজেদা যদি এসব করতে পারে, তাহলে অন্যরা নয় কেন? আমরা সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি, তাহলে দেশের কোথাও আর বাল্যবিবাহ হতে পারবে না। সাজেদা হোক আমাদের প্রেরণার উৎস। আসুন, আমরা সবাই সাজেদাকে অনুসরণ করি।