নানা পদক্ষেপের কারণে ইলিশের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বছরে প্রায় ৪ লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন নতুন মাইলফলক স্পর্শ করবে। আশা করা যায় উৎপাদন ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বঙ্গোপসাগরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ইলিশ ধরা পড়েছিল দুই লাখ টন। এর পর ইলিশ সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ নেয়ায় ইলিশ উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
ইলিশের অভয়াশ্রম গড়ে তুলে জাটকা মাছ রক্ষার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মার্চ-এপ্রিল মাসে পদ্মা-মেঘনা নদীর প্রায় সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পাশাপাশি ইলিশ মাছ ধরে যেসব জেলে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা যেন সমস্যায় না পড়েন সে লক্ষ্যে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকায় ২ লাখ ২৬ হাজার ৮৫২ জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। এর মোট পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ১৭১ টন। এ ছাড়া জেলে পরিবারকে স্বল্প সুদে ঋণ, সেলাই মেশিন ও আয়বর্ধক নানা কাজে উৎসাহী করা হয়েছে। বিশেষ করে যারা ইলিশ ধরেন, এমন জেলেদের নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে ইলিশ উৎপাদনে সফল হয়েছে সরকার।
বিশ্বে দেশের ইলিশের নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। ইলিশ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড তো বটেই, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতিতেও অনুসরণকারী অন্যতম দেশ। কেননা ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই যেখানে ইলিশের উৎপাদন কমছে, সেখানে একমাত্র বাংলাদেশেরই ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
ইতোমধ্যেই দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার কৌশল অনুসরণ করতে শুরম্ন করেছে ভারত ও মিয়ানমার। আর কৌশল বুঝতে বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ শুরম্ন করেছে কুয়েত ও বাইরাইন। ফলে শুধু রসনা বিলাসই নয়, রম্নপালি ইলিশ হতে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম মাধ্যমও।
সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ বাংলাদেশে ধরা পড়েছিল। এরপর গত দেড় যুগে আর এত বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ার নজির নেই। হঠাৎ করে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। তবে হঠাৎ নয়, স্বাভাবিকভাবেই ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। মূলত জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ এবং মাছের অভয়ারণ্য বাস্ত্মবায়নের কারণেই ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। মা ইলিশ ও ডিম বাড়ছে, মাছও বাড়ছে। ২০০৯ সালে সাগর নদী বিধৌত উপকূলীয় এলাকা চাঁদপুর, লক্ষ্ণীপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীর ২১ উপজেলায় জাটকা নিধন বন্ধ, মা ইলিশ রক্ষা ও ইলিশের বংশ বিস্ত্মারের জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। পরে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশের ২৫ জেলার ১৩৬টি উপজেলায়। তার সুফল এখন আমাদের হাতে। ইলিশের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকার এ বছর ১৫ দিনের জায়গায় ২২ দিন, অর্থাৎ আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত্ম জাটকা নিধন ও মা ইলিশ সংরক্ষণের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। এ সময় কেউ ইলিশ ধরতে পারবে না। বাংলাদেশের পদ্মা ও মেঘনার মিষ্টি পানির প্রবাহ এখনো ভালো থাকায় এবং প্রয়োজনীয় খাবার থাকায় ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে ইলিশের অভয়ারণ্য করে ইলিশের ডিম ছাড়ার স্থান করে দিয়েছে এবং জাটকা বড় হতে দিচ্ছে। তবে ইলিশের ব্যাপক উৎপাদন জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধের পাশাপাশি সমুদ্র তলদেশের ধরনকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা মূলত ‘এলননো’র কারনে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। এলননোর কারণে সমুদ্র তলদেশের পানি গরম হয় ও সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ে। পানি লবণাক্ততা ও মাছের চলাচলের জন্য পানির উপযোগিতা বাড়ে। ফলে দেশের সমুদ্র ও নদীগুলোতে মাছের সমাগম হয় ও মাছের প্রজনন সহজ হয়। কিন্তু প্রতি বছর যে এমন হবে তা নয়। প্রতি ১০-১২ বছর পর পর সমুদ্রে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই বলে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন এমনই থাকবে তা ঠিক নয়। এর জন্য মাছের বিচরণ ক্ষেত্র সমুদ্র ও নদী গবেষণা প্রয়োজন।
মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে উৎপাদন ছিল তিন লাখ ১৩ হাজার টন, সর্বশেষ ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৮৫ হাজার টনে। চলতি বছর ইলিশের উৎপাদন ৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। অন্যদিকে, গত বছর এক কেজির বেশি ওজনের অর্থাৎ বড় ইলিশ ধরা পড়ছে ২০ শতাংশ বেশি এবং আগের বছর সবচেয়ে বড় আকৃতির মধ্যে ৪০ থেকে ৪৮ সেন্টিমিটার আকৃতির ইলিশ ধরা পড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। দেশের ১০০টি নদীতে কমবেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও ইলিশের প্রজনন ও পরিপক্কতা দক্ষিণাঞ্চলে নদীতেই হয়। এ অঞ্চলের মেঘনা নদীর ষাটনল থেকে লক্ষ্ণীপুরের আলেকজান্ডার, ভোলার শাহবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া নদী, পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ- এই ৫টি চ্যানেলকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। অক্টোবর ও জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারিকে ইলিশের প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। ইলিশের বাস সাগরে। কিন্ত্ম ডিম ছাড়ার আগে নদীর মিঠাপানিতে আসে। ডিম ছাড়ার সময় হলে দিনে ৭০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ায় ইলিশ সাগর থেকে যতই নদীর মিষ্টি পানির দিকে আসে, ততই এর শরীর থেকে লবণ কমে যায়, স্বাদ বাড়ে। একটি মা-ইলিশ সর্বনিম্ন দেড় লাখ ও সর্বোচ্চ ২৩ লাখ পর্যন্ত্ম ডিম দেয়। ইলিশ সাগর থেকেও ধরা হয়, কিন্তু সাগরের ইলিশে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায় নদীর ইলিশের মতো সুস্বাদু হয় না। বাঙালির প্রিয় ইলিশ মাছের বংশবৃদ্ধি উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমার পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছে। সম্প্রতি ঢাকায় ইলিশ সংক্রান্ত্ম এক সেমিনারে তিন দেশের প্রতিনিধিরা এই অঙ্গীকার করেছেন।
প্রতি বছর এই দেশগুলোতে ৩৮ লাখ টনেরও বেশি ইলিশ ধরা হয়, যার শতকরা ৬০ ভাগ ধরা হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা নেই। ইলিশ মাছ রক্ষায় এই তিনটি দেশ নিজের মতো করে পদক্ষেপ নিচ্ছে। দেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের মোট মাছের ১২ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে, যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত ইলিশের যেটুকু রফতানি হয় তাতে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ লোক পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। অন্যদিকে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাড়ে আট হাজার টন ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা।
তবে ইলিশ নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও আগামী ১০ বছর পর এ ধারা অব্যাহত থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ইলিশ মিয়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে। এ কারণেই ইলিশ মাছের বংশবৃদ্ধি, উৎপাদন ও সংরক্ষণে গ্রহণ করা হয়েছে ত্রিদেশীয় উদ্যোগ। বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমার এ লক্ষ্যে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে। বিশ্বে প্রতি বছর ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়, এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ টনের মতো। এই হিসাবে প্রচলিত বাজারমূল্যে প্রতি কেজির গড় দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলেও সংগৃহীত সাড়ে তিন লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এ বছর মাছের বাজারমূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। ইলিশ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে দেশের ইলিশ মাছ বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এখনো দেশে ইলিশের মাইগ্রেশন পথ, অর্থাৎ আসা-যাওয়ার পথ চিহ্নিত করা যায়নি। এ নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই। ফলে কখন ইলিশ আসে, কখন যায়, কোন পথ দিয়ে যায়, তা জানা না গেলে জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ করা যাবে না। এ বছার ইলিশ মাছ কেন এত বেশি, তা জানার কোনো পথ নেই। কারণ এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। ১১ দিন ডিমওয়ালা মাছ বন্ধ রাখা ও জাটকা নিধন করতে না দেওয়ার ফলই বা কতটুকু তাও জানা নেই। সুতরাং সঠিক গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে এলননোর কারণে এবার মাছের উৎপাদন বেশি, সেই এনিনো সম্পর্কে সরকারের লোকজনের ধারণা থাকতে হবে। নতুবা মাছ এসে ফিরে যাবে, সংরক্ষণ করা যাবে না। নদীগুলো ইলিশ উপযোগী কি না বা মাছ সংরক্ষণ মৌসুম কতদিন রাখতে হবে, সেটি জানতে গবেষণা প্রয়োজন।
ইলিশ জাতীয় সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রয়োজনে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জটিকা নিধন রোধে সরকার কঠোর অবস্থানে থাকবে। যে কোনো মূল্যে সরকার নদী থেকে জাটকা ধরা বন্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সবার সহযোগিতা চায়।