দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত সুফল স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূর্য। বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১৯৭১ সালে সারা দেশেই মরণপণ লড়াই করেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে তাদের স্মৃতি। কোথাও পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করেছে। কোথাও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন নারী, শিশুসহ মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নাকানি-চুবানি খেয়ে চরম পরাজয় মেনে নিয়েছে অনেক জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক জায়গার বিস্তারিত বর্ণনা আছে ইতিহাসে। আবার অযত্ন অবহেলায় অনেক জায়গার স্মৃতি ভুলতে বসেছে সাধারণ মানুষ। অযত্ন আর অবহেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি লালন করছে এমন ৩৬০টি জায়গা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ শীর্ষক একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রয়েছে এমন ৩৬০টি স্থানের গুরুত্ব বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ভাস্কর্য, স্মৃতি জাদুঘর, স্মৃতিস্তম্ভ, ম্যুরাল, টেরাকাটা ও লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৭৯ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। কয়েক দফায় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা শেষে প্রস্তাবটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হচ্ছে। অনুমোদন পেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। দেশের ৬৪ জেলার ২৯৪ উপজেলা প্রকল্পটির আওতাভুক্ত রয়েছে। কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হচ্ছে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ হলেও সব এলাকার ঐতিহাসিক স্থান এখনও শনাক্ত করে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু জায়গার নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। গুরুত্ব বিবেচনায় এসব স্থানের ৩৬০টি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলো রক্ষার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মহিমা সমুন্নত রাখার লক্ষ্য সামনে রেখে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গুরুত্ব বিবেচনায় এসব স্থানকে দুইটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৪৭ স্থানকে টাইপ-এ ক্যাটাগরি ও স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ৩১৩ স্থানকে টাইপ-বি ক্যটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টাইপ-এ ক্যাটাগরির আট জায়গায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ, ম্যুরাল বা টেরাকাটা নির্মাণ করা হবে। এ-টাইপ ক্যাটাগরির অন্য ৩৯ স্থানে একটি লাইব্রেরিসহ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। এসব স্থাপনায় ছোট আকারের সম্মেলন কক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কের কক্ষ থাকবে।
এদিকে টাইপ-বি ক্যাটাগরির ৩১৩ ঐতিহাসিক স্থানে আয়তাকার দুইটি স্তম্ভ ও বেদি স্থাপন করা হবে। তাছাড়া দর্শনার্থীদের বসার জায়গা, শিশুদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ওয়াশ ব্লক ও খাবারের দোকান থাকবে এসব স্থাপনায়। টাইপ-এ ক্যাটাগরির স্থাপনা নির্মাণে ৫৮ লাখ ৭ হাজার টাকা করে বরাদ্দ থাকবে। আর টাইপ-বি ক্যাটাগরির প্রতিটি স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় করা হবে ৩৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য জুয়েনা আজিজ জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মহিমা সমুন্নত হবে। তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে। এসব বিষয় বিবেচনায় প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সুপারিশ করেন তিনি।