‘দ্য গেস্নাবাল অ্যাকুয়াকালচার প্রডাকশন স্ট্যাটিস্টিকস ফর দ্য ইয়ার-২০১৫’-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে চাষকৃত মাছের বার্ষিক উৎপাদন ১৬ লাখ টন। তাদের জরিপে ফিশ অ্যাকুয়াকালচার বা চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার পরই পঞ্চম স্থানটি বাংলাদেশের। শীর্ষস্থানে থাকা চীনের বার্ষিক উৎপাদন ৩৮ লাখ ৬২ হাজার টন, ভারত ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার, ভিয়েতনাম ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ও ইন্দোনেশিয়া প্রতিবছর গড়ে ২৭ লাখ ১৮ হাজার টন। এই আশার খবরের প্রতিফলন হচ্ছে মাছ থেকে দেশে আমিষের চাহিদার ৬০ শতাংশের জোগানই আসছে…
এস এম মুকুল
আশার খবর দিয়েই শুরম্ন করি। ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ৬০ ভাগ আমিষের চাহিদা পূরণ হয় এই খাত থেকে। পাশাপাশি মাছ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)-এর ‘দ্য গেস্নাবাল অ্যাকুয়াকালচার প্রডাকশন স্ট্যাটিস্টিকস ফর দ্য ইয়ার-২০১৫’-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে চাষকৃত মাছের বার্ষিক উৎপাদন ১৬ লাখ টন। তাদের জরিপে ফিশ অ্যাকুয়াকালচার বা চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার পরই পঞ্চম স্থানটি বাংলাদেশের। শীর্ষস্থানে থাকা চীনের বার্ষিক উৎপাদন ৩৮ লাখ ৬২ হাজার টন, ভারত ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার, ভিয়েতনাম ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ও ইন্দোনেশিয়া প্রতিবছর গড়ে ২৭ লাখ ১৮ হাজার টন। এই আশার খবরের প্রতিফলন হচ্ছে মাছ থেকে দেশে আমিষের চাহিদার ৬০ শতাংশের জোগানই আসছে। আমরা জানি, বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে মৎস্য খাতের অবদান ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ বা দেড় কোটির বেশি মানুষ বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল।
রম্নপালি বিপস্নবের পথে যাত্রা
দেশে জলাশয় হিসেবে আমাদের স্থানীয় মৎস্য চাষের আওতায় রয়েছে ৪৭ লাখ হেক্টরের বেশি জমি। নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক ও পস্নাবনভূমিকে মুক্ত জলাশয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব এলাকার মোট বিস্ত্মৃতি প্রায় ৪০ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর। অন্যদিকে বদ্ধ জলাশয় হিসেবে ধরা হয় পুকুর, আধাবদ্ধ জলাশয়, বাঁওড় ও চিংড়ি খামারগুলোকে। এসব এলাকার বিস্ত্মৃতি ৬ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর। মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে দেশের ৮২ শতাংশের বেশি মাছ উৎপাদন হয়। বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে পুকুর, আধাবদ্ধ জলাশয়, বাঁওড় ও চিংড়ি খামারে উৎপাদন হচ্ছে ৪৮ শতাংশ মাছ। এ ছাড়া মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদন হচ্ছে ৩৪ শতাংশ। বিভিন্ন তথ্য বিশেস্নষণ করে দেখা গেছে দেশে চাষকৃত মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নীরব বিপস্নব ঘটিয়েছে দেশের ক্ষুদ্র বেসরকারি উদ্যোক্তরা। যদিও এই উৎপাদন বাড়ার পেছনে সরকারি ও বেসরকারি উভয়েরই গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মৎস্য খাতের অবদানের পেছনে বিশেষত সরকারের মাছের অভয়াশ্রম ও প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ এবং মৎস্য আইন বাস্ত্মবায়নও বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া পোনা অবমুক্তি, বিল ও নার্সারি স্থাপন, পোনা সংরক্ষণ কর্মসূচি, পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ, বদ্ধ জলাশয়ে নিবিড় মৎস্য চাষ, সামাজিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ ও মৎস্য চাষিদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে মাছ উৎপাদন বাড়ছে। এ ছাড়া মৎস্য জেলা হিসেবে ময়মনসিংহে রেণু ও পোনা উৎপাদনে হ্যাচারি শিল্প গড়ে উঠেছে, যা দেশের প্রায় সব জেলায়ই মৎস্য চাষ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জেলেদের পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যার মাধ্যমে জেলেরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন। বহুবিদ সম্ভাবনা আর অবারিত সুযোগের কারণেই এখন খামারিদের মধ্যেও মৎস্য চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
ঘরের ভেতর মাছের চাষ
বাংলাদেশে একেবারে নতুন হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই এ পদ্ধতি খুব জনপ্রিয়। দেরিতে হলেও আমাদের দেশে ময়মনসিংহের মৎস্য চাষি ফিশ হ্যাচারি ও কালচার ফার্ম অ্যাগ্রো ত্রির স্বত্বাধিকারী এবিএম শামছুল আলম বাদল ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরএএস প্রযুক্তিতে মাছ চাষ শুরম্ন করেন। গবেষণায় দেখা গেছে এই পদ্ধতিতে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঘরের ভেতর মাছ চাষ করে পুকুরের চেয়েও প্রায় ৩০ গুণ বেশি উৎপাদন সম্ভব। রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিতে এক ঘনমিটার পুকুরে দুই কেজি মাছ হলে এই পদ্ধতিতে ৫০ থেকে ৬০ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। এই উদ্যোক্তা ময়মনসিংহ শহরের বিসিক শিল্পনগরীর একটি টিনশেড পস্নটে ১০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৮টি ট্যাঙ্ক স্থাপন করেন। প্রতিটি ট্যাঙ্কে পাইপ দিয়ে মেকানিক্যাল ফিল্টার সংযুক্ত করা হয়েছে। মেকানিক্যাল ফিল্টারের কাজ প্রতিটি ট্যাঙ্কের মাছ ও মৎস্য খাদ্যের বর্জ্য পরিষ্কার করা। পরে এ পরিষ্কার পানি পাম্প দিয়ে বায়োফিল্টারে উত্তোলন করা হয়। এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত মাছের গুণগতমান অনেক উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। উদ্যোক্তার মতানুযায়ী এ পদ্ধতিতে মূলত ক্যাটফিশজাতীয় মাছ (পাবদা, গোলসা, শিং, মাগুর) চাষ করা হয়। বর্তমানে ৮টি ট্যাঙ্কে তিনি পাবদা ও গোলসা মাছ চাষ করছেন। তিনি জানান, এ ধরনের চাষ-পদ্ধতিতে মাছের খাদ্য কম লাগে। উৎপাদিত মাছ স্বাভাবিক মাছের তুলনায় আকারে বড় হয়। রোগবালাই ও মড়কের আশঙ্কা নেই।
লাখোহাটিতে লাখোপতি
খুলনা মহানগরীর দীঘলিয়া উপজেলা ছোট্ট একটি গ্রামের নাম লাখোহাটি। জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে এ গ্রামের বাসিন্দা হরিপদ বিশ্বাস প্রথমে সাদা মাছের পোনা পরিচর্যার ব্যবসা শুরম্ন করেন। কয়েক বছর পর তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলে তার দেখানো পথেই সাদা মাছের পোনা পরিচর্যায় স্থানীয়রা ঝুঁকে পড়ে। যদিও এক সময় খুবই দরিদ্র ছিল গ্রামের মানুষ। কিন্তু সাদা মাছের পোনা বদলে দিয়েছে গ্রামের কয়েকশ’ পরিবারের জীবনযাত্রা। লাখোহাটি গ্রামের ঘরে ঘরে এখন লাখোপতি। বছরে এ গ্রামে শতকোটি টাকারও বেশি সাদা মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে। এসব গ্রামের খাল-বিল, ডোবা-নালা, ঘের ও পুকুর যেখানেই পানি, সেখানেই রম্নই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গস্নাস কার্প, পুঁটি মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মণ মাছের পোনা ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে।
অব্যবস্থাপনায় বিনষ্ট এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন
হতাশার খবরটি হচ্ছে- অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় অপচয় হচ্ছে উৎপাদিত মাছের এক-তৃতীয়াংশ বা বছরে প্রায় ১১ লাখ টন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদপ্তরের গবেষণায় জানানো হয়েছে, দেশে উৎপাদিত মাছের বিরাট অংশই অপচয় হচ্ছে। মাছ নষ্ট হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী পরিবহন এবং সংরক্ষণে অদক্ষতা। সঠিক মাত্রায় পরিবহন এবং সংরক্ষণ করতে না পারাতেই ১৫-১৭ শতাংশ মাছ নষ্ট হয়। অন্যপক্ষে খুচরা ও পাইকারি বাজারের বিক্রেতাদের অদক্ষতার কারণেও নষ্ট হচ্ছে মাছের ২-৫ শতাংশ। দেশে এখনো একজন মানুষের বছরে মাছের ঘাটতি রয়েছে প্রায় আড়াই কেজি। অর্থাৎ প্রতিবছরে এখনো মাছের ঘাটতি প্রায় চার লাখ টন। আর ১০ লাখ টন অপচয় হিসেবে নিলে তা প্রকৃতপক্ষে হবে প্রায় ১৪ লাখ টন। গবেষণায় দেখা গেছে- দেশের মোট উৎপাদিত মাছের মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ তাজা হিসেবে ভোক্তারা পাচ্ছেন। আবার দেশে ৪০ শতাংশ মাছের বরফ প্রয়োজন হলেও সংশিস্নষ্টরা তা ব্যবহার করছেন না। তার মধ্যে ৮৮ শতাংশ জেলে, ৭৭ শতাংশ খামারি বা কৃষক, ২৭ শতাংশ রিটেইলার এবং ৪৭ শতাংশ ভেন্ডররা মাছে বরফ ব্যবহার করছেন না।
কাজে লাগাতে হবে সম্ভাবনা
মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ খাতের সম্প্রসারণ হার বেশি হলেও অপচয়ের কারণে মাছের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাছের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যপণ্য উৎপাদন হলেও এ দেশে তেমন কোনো সুযোগ নেই। অথচ মাছের এ ধরনের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে তেল, অয়েল কেক ও খাবার তৈরি এবং শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল তৈরি করে বছরে বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব। সরকার দেশের মাছ উৎপাদন বাড়াতে যতটা নজর দিচ্ছে, ঠিক ততটাই অবহেলা করা হচ্ছে এর সংরক্ষণ কিংবা পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াজাতকরণকে। তা ছাড়া মাছ উৎপাদনে জড়িত এবং বিপণন প্রক্রিয়ায় যারা নিয়োজিত তাদেরও দক্ষতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাজা মাছ বিপণন করতে এখনো দেশে উন্নত অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। খামারি বা জেলেরা এখনো বরং পুরনো পদ্ধতিতে মাছ বিপণন করে যাচ্ছেন। পরিবহনব্যবস্থারও দুর্বলতা রয়েছে। মৎস্য পরিবহনের জন্য ফ্রিজিং পিকাপ ব্যবস্থাকরণ দরকার। এসব বিষয়ে সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মনযোগ দেয়া জরম্নরি।