বিদেশি ফল ড্রাগন এখন আর ‘বিদেশি’ নেই, চাষ হচ্ছে দেশেই। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ছাপিয়ে এখন ফরিদপুরেও গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে ড্রাগন।
ফরিদপুরে ড্রাগন চাষে অগ্রগণ্য নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের সন্তোষী গ্রামের চাষি বিমল চন্দ্র সরকার। শুরুর দিককার প্রতিকূলতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশি ফল বলে কেউ চাষ করতে চায়নি। আমি সাহস করে বাগান করার তিন বছরের মাথায় সফল হয়েছি। ’
ধাপে ধাপে সফল হওয়ার কথা জানিয়ে বিমল আরো বলেন, ‘বলতে গেলে প্রথম বছর ফলনই হয়নি। দ্বিতীয় বছর আরো যত্ন নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মাত্র আট কেজি ফল ধরেছিল। সেই ফল আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের খেতে দিয়েছি। আর তৃতীয়, মানে এ বছর এসে সফল হই। প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ করে এ বছর যে ফল পেয়েছি তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দ্বিগুণ লাভ করেছি। ’
বিমল জানালেন, বাড়ির পাশের ১৫ শতাংশ জমিতে একসময় বিভিন্ন সবজি চাষ করতেন তিনি।
তিন বছর আগে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে ওই জমিতে ড্রাগন ফলের বাগান করেন। বাগান তৈরিতে ৭০টি খুঁটি ও গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার ব্যবহার করেছেন। এতে একটি খুঁটিতে দুটি গাছ। সেই হিসাবে মোট ১৪০টি গাছ রয়েছে এখন।
জানা গেল, ফাল্গুন মাসে ড্রাগন গাছে প্রথমে ফুল ফোটে। ফুল শুকিয়ে গিয়ে ফল বের হয়। সবুজাভ রঙের গাছ দেখতে অনেকটা ক্যাকটাসের মতো। রাতে ফুল ফোটে। দিনে দিনে সেই ফুল শুকিয়ে পাপড়ি ঝরে ফলে রূপান্তর হয়। একেকটি ফল ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। একটি গাছ প্রায় ৪০ বছর বাঁচে।
সচরাচর চার রঙের ফল দেখা যায় বাজারে—লাল বাকল, লাল শাঁস; হলুদ বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল, সাদা শাঁস এবং লাল বাকল, নীলচে লাল শাঁস। তবে বিমলের বাগানের ড্রাগন লাল বাকল, লাল শাঁসের।
বিমল জানান, এ বছর ৩০ কেজির বেশি ফল হয়েছে। বাজারে মৌসুমের শুরুতে কেজিপ্রতি ৭০০ টাকা এবং মৌসুমের শেষ দিকে ৪০০ টাকা করে বিক্রি করেছেন। সব মিলিয়ে এ বছর খুব ভালো দাম পেয়েছেন। তাই ভবিষ্যতে আরো জমিতে বাগান করার কথা জানালেন তিনি। তা ছাড়া এই বাগান থেকে বিমল অন্য কৃষকের কাছে চারাও বিক্রি করছেন।
একই ইউনিয়নের বিলগোবিন্দপুর গ্রামের আরেক ড্রাগন চাষি সরদার অহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমি এ বছরই ৬৬ শতাংশ জমিতে ড্রাগন ফলের বাগান করেছি। ফলনও পেয়েছি। ’ তিনি জানান, বাগান করতে প্রথমে চারপাশে তিন ফুট গভীর গর্ত এবং পরে গোবর সার দেন। ড্রাগন গাছ খুঁটি ও টায়ারের সাহায্যে দাঁড় করিয়ে রাখেন। একই বাগানে বেগুন, ডাঁটা, ওলকচুসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করা যায় বলে তিনি জানান।
ড্রাগন চাষের ব্যাপারে নগরকান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আশুতোষ কুমার বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন বছর আগে ফরিদপুরের হর্টিকালচার সেন্টার থেকে আমি প্রথম ড্রাগন ফলের চারা গাছ পাই। পরে সেটা চাষের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করলে বিমল রাজি হয়। তাকে সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিন বছরের মাথায় সে সফল হয়। ’
কৃষি কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে এ উপজেলায় ১০ জন চাষি ড্রাগন ফলের বাগান করেছে। এর মধ্যে অবশ্য প্রথম সফল চাষি বিমল। সে এখন চারাও বিক্রি করছে। তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে অন্যরা ড্রাগন চাষে উৎসাহী হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ফরিদপুর জেলার মাটি ও আবহাওয়া চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় এখানে ড্রাগন ফল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বাজারে ফলের ভালো দাম ও চাহিদা রয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ও প্রচুর পুষ্টিগুণসম্পন্ন ড্রাগন ফল মিষ্টি ও টক-মিষ্টি স্বাদের। এ ফলে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে। এ ছাড়া একই বাগানে সবজিসহ তিল, মসুর ও মাসকালাইয়ের চাষ করা যায়। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে বলেই ড্রাগন ফল চাষে তারা আগ্রহী হয়ে উঠছে।
ফরিদপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, ড্রাগন ফলটি ইন্দো-চীন (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও চীন) এলাকায় খুব জনপ্রিয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘হাইলোসিরিয়াস আনডাটাস’ ( Hylocereus undatus)। এটি গ্রীষ্মকালীন ফল বলে এ দেশেও এর চাষ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফুল ও ফল পাওয়া যায়। একটি চার বছরের পূর্ণাঙ্গ গাছে ৪০ থেকে ৮০ কেজি ফল পাওয়া যায়। তা ছাড়া এই ফলের রঙিন খোসা থেকে পাওয়া প্রাকৃতিক রং শরবত বা জুস তৈরিতে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, বর্তমানে জেলার তিনটি উপজেলায় এ ফলের চাষ হচ্ছে। উপজেলাগুলো হলো নগরকান্দা, সদর ও মধুখালী উপজেলায়। এর মধ্যে নগরকান্দার চাষিরা এরই মধ্যে সফলতার মুখ দেখেছে।
সরকারি সহযোগিতা ও সঠিক দাম পেলে আগামীতে এ অঞ্চলে ড্রাগন ফল চাষ আরো বাড়বে বলে মনে করছে এ অঞ্চলের কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্টরা।