পদ্মা সেতু খুলে দেবে সম্ভাবনার দুয়ার

স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যুগপৎ সড়ক ও রেলপথ উন্মুক্ত হলে ঘুরতে শুরু করবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম হবে। জেলাগুলোয় আরও আধুনিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে

অনেক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনার অবসান ঘটিয়ে বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে চলেছে সেতুর অবয়ব। দীর্ঘদিন ধরে পদ্মার তলস্পর্শী জলের ভেতর নানা কর্মযজ্ঞ শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে সেতুর জাজিরা পয়েন্টে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পায়ারের স্প্যানের ওপর বসানো হয় স্টিল স্ট্রাকচারটি। চীনে তৈরি এ স্প্যানটির অংশগুলো সমুদ্রপথে জাহাজে করে দেশে আনা হয়। সেখান থেকে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে তা ফিটিং করা হয়। এটির ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। জাজিরা পয়েন্টে এটি আনার জন্য ব্যবহার করা হয় ৩ হাজার ৭০০ টন ওজনের একটি ভাসমান ক্রেন। সেতুর দ্বিতীয় স্প্যানটি অক্টোবর মাসের শেষের দিকে স্থাপন করা হবে। মাওয়ায় আরও ১০টি স্প্যান চলে এসেছে। চীন থেকে ১২টি স্প্যান শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এভাবে ৪২টি পায়ারের ৪১ স্প্যানের ওপর স্থাপিত হবে সেতুর ৪১টি স্টিল স্ট্রাকচার। এ স্ট্রাকচারের ওপর চলবে সেতু নির্মাণের অন্যান্য কাজ। সড়কপথে যান চলাচলের জন্য নির্ধারিত ১৫ মিটার চওড়া কংক্রিটের সড়কের বাইরেও সেতুর মধ্যে থাকবে রেললাইন, গ্যাসলাইন ও অপটিক্যাল ফাইবার। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১ বছর ৯ মাস পর প্রথম দৃশ্যমান হলো এর মূল কাঠামো।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে সেতু নির্মাণকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং জোরেশোরে এর কাজ শুরু হয়। বিশাল প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণের পরীক্ষামূলক পাইলিং শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে। প্রধানমন্ত্রী শরীয়তপুর জেলার জাজিরার নাওডোবায় নদী শাসনের কাজ উদ্বোধন করার পর মাওয়া প্রান্তে মূল পাইলিং কাজেরও উদ্বোধন করেন। নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠন-জটিলতা কাটিয়ে স্রোতকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে সেতুর নির্মাণ কাজ। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে সেতুর পাইলিং কাজ চলে নদীর দুই পাড়েই। জাজিরা অংশে সব ক’টি পিলারের পাইলিংয়ের মাটি পরীক্ষা সমাপ্ত। নদীর পানির স্তরের ৫০ ফুট উঁচুতে প্রতিটি স্প্যান বসানো হবে। মূল নদীর মধ্যে ১৫০ মিটার পর পর ৪২টি পিলারে ছয়টি করে মোট ২৫২টি পাইল করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি পাইলের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ৫৮টি পাইলের কাজ হয়েছে ৫০ শতাংশ। প্রস্তুত করা স্প্যানের লোডটেস্টও সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে পাঁচটি স্প্যান বসানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ৩০ সেপ্টেম্বর একটি স্প্যান বসানোর পর আশা করা হচ্ছে, বাকি সময়ের মধ্যে ৪০টি স্প্যান বসিয়ে সব কাজ সমাধা শেষে ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু করা সম্ভব হবে।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর সব প্যাকেজে পুরো কাজের প্রায় ৪৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ, নদী শাসনের কাজও ৩৪ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের উল্লেখযোগ্য জাজিরা পয়েন্টে কাজের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ, মাওয়া সংযোগ সড়কের সম্পূর্ণ শেষ এবং সার্ভিস এরিয়ার কাজও শতভাগ শেষ হয়েছে বলে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। মাওয়া ও জাজিরা দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রসহ পদ্মা সেতুর পুরো প্রকল্পে দেশি-বিদেশি অসংখ্য শ্রমিক প্রতিদিন কর্মরত রয়েছেন। পদ্মা সেতুর ১১ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের মধ্যে সাড়ে ৯ কিলোমিটার সড়কই জাজিরা পয়েন্টে ও বাকি দুই কিলোমিটারের মতো সড়ক মাওয়া অংশে পড়েছে। এছাড়া সংযোগ সড়কের মধ্যে থাকছে ৯৭০ মিটারের পাঁচটি সেতু, ২০টি বক্স কালভার্ট, আটটি আন্ডারপাস ও দুইটি টোল প্লাজা। ২০টি কালভার্টের নির্মাণ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। সেতু পারাপারের জন্য টোল আদায়ে ব্যবহৃত দুইটি টোল প্লাজার নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। এখন পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দিনরাত চলছে হাজারো মানুষের কর্মব্যস্ততা। সেতুর দুই প্রান্তে পুরোদমে চলছে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ। নদী শাসনের জন্য ব্লক তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি।
২০১২ সালের ২৯ জুন আকস্মিকভাবে ১২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণ বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে দেশের কোটি মানুষের পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন যেন নিরাশায় পর্যবসিত হয়। সেতু ও সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৮ জুন চীনের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়। তাতে ব্যয় ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদী শাসনের জন্য চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার কোটি টাকার কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি এবং নিচ দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে। সেতুর উপরের তলায় থাকবে চার লেনের মহাসড়ক। মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত হবে চার লেনের সড়ক। রাজধানীর কেন্দ্র বিজয়নগর থেকে মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য উড়ালপথের দৈর্ঘ্য হবে ১৩ কিলোমিটার। এশিয়ান হাইওয়ের সংযোগ হিসেবেও সেতুটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। নিচতলায় স্থাপিত হবে রেললাইন, যা হবে ১৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রথম পর্যায়ে রাজধানীর গে-ারিয়া থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাঙ্গা থেকে নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপিত হবে। এ প্রকল্পেই বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর ওপরসহ ছোট-বড় নদীতে মোট ১২৫টি সেতু নির্মিত হবে। এছাড়াও রেলপথে তিনটি ফ্লাইওভারসহ ৪০টি লেভেলক্রসিং ও আন্ডারপাস থাকবে। এ সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। সেতু নির্মাণ প্রকল্পে পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মূল সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, নদী শাসন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। সেতুটি নির্মাণে পূর্ণতা লাভ করলে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে আশাতীত সাফল্য বয়ে আনবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের শুভ সূচনায় দেশকে হংকংয়ের মতো নগর গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যুগপৎ সড়ক ও রেলপথ উন্মুক্ত হলে ঘুরতে শুরু করবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম হবে। জেলাগুলোয় আরও আধুনিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে। পণ্য পরিবহন দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হলে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে; অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের বিশাল সুযোগের মধ্য দিয়ে জীবন-জীবিকার রূপ পাল্টে যাবে; দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। এরই মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের দীর্ঘতম এ সেতু জনগণের জন্য উন্মুক্ত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। পদ্মাপাড়ের তিন জেলা মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের উন্নয়নের ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আশা করা যাচ্ছে। সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে পদ্মার দুই পাড়ে সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোয় জনসাধারণের জন্য মসজিদ, খেলার মাঠ, মার্কেটসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। এককালের দেশের কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই স্থাপিত হবে বাংলাদেশের সক্ষমতার মাইলফলক। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক ও রেলপথে চলাচল উন্মুক্ত হলে এর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ, যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহ কঠোর নিয়ন্ত্রণ তদারকি, বিশেষ করে সড়ক ও সেতু ব্যবহারকারীদের সচেতনতা-দায়িত্ববোধের ওপর নির্ভর করবে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতা এবং সার্থকতা। আর তা সম্ভব হলে আগামী দিনে বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর চেয়েও বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। দেশকে স্বাবলম্বী করে তোলাই হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বাক্ষর।